একটি বাড়ির বায়োপিক/ দিশারী মুখোপাধ্যায় / আংশিক
- Get link
- X
- Other Apps
১)
উল্টোদিক
উল্টোদিক থেকেই শুরু করুন।অর্থাৎ একশো-কে
বুঝতে শেখান কীভাবে সে হলো এতোটা।যেমন
সাদা পর্দাটা জানতে পারল কেমন করে সে
এই শুভ্রতা অর্জন করেছে।বুঝল এই অর্জন
আসলে অনেকটাই উপহারের সমন্বয় কিংবা
সে নেহাতই গতপুরুষের একজন নমিনি।
পর্দার মাঝখান থেকে আলো নিভতে শুরু করল
সম্পূর্ণ পর্দাটা ধীরে ধীরে কালো হলো।
অকস্মাৎ একজন অদৃশ্য পেইন্টার পর্দার মাঝে
একবিন্দু সাদা রাখল।বাকি যাকিছু ঘটনা
সবই ওই সাদা বিন্দুটির খেল।কোনো ক্রিয়াপদেই
ফাইনাল হুইশেল বাজে না।
সমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার একটি যান্ত্রিকতা মাত্র,
সে নিজেও জানে।
#
২)
জানে
জানে তাকে একটা বাড়িতে পৌঁছাতে হবে।কারণ
সে বাড়িতে জন্ম নেবে আগামীদিনের এক যাত্রী।
একটি সাদা বিন্দু থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে
সে একটা অবয়ব নিল। অবয়বটি বাড়ির দরজার
কাছে এসে পৌঁছাবে।আঁকার উদ্যোগে ব্যস্ত রয়েছে
চিত্রশিল্পী।বাড়ির দরজা যখন তার হাতের স্পর্শ
চেয়ে অধীর,পিছনের এক বাড়ি থেকে কোনো সুখাদ্যের
ঘ্রাণ তার কানে এলো।তীব্র সে ডাক।অবয়বটি
তৎক্ষণাৎ সংখ্যায় বেড়ে এক থেকে দুই হলো।একজন
সেই বাড়ির ডিনারটেবিলে পৌঁছে গেল ঘ্রাণাহূত,
অন্যজন প্রবেশ করল এই বাড়িতে।
বাড়িতে ঢুকেই এক করবীগাছের সঙ্গে দেখা।না,সে
রক্তকরবী নয়।একেবারে সাদা।নিচুগলায় দুএকটি
কথা বলল।অবয়বটির এই দ্বিতীয় অংশটির মনে
পড়ল, ক্রিয়াপদকে অসম্পূর্ণ রাখতে শিখিয়েছিল
এমন একজনের কথা।
#
৩)
কথা
কথা বলতে বলতে সে যখন অতিক্রম করছে
বাড়ির উঠোন, ঘরে ঘরে জ্বলে উঠল তার জন্য
আমন্ত্রণ।সঠিক ঘর তাকে চিনে নিতে হবে।যে ঘরে
পা দিলেই সে একটা আয়না দেখতে পাবে। আয়নাটিও
তাকে দেখার জন্য বহুকাল ধরে গ্লুকোমা সারিয়ে
বসে আছে।বসে থাকা আর দেখা।দুটো মাত্র ক্রিয়াপদ
সে আয়নার।লোকে বলে,সব আয়নাই নাকি এমন।
একটিমাত্র ঘরের আলোয় মিশে আছে হাল্কা মাত্রায়
বিসমিল্লা খাঁ।চিনতে অসুবিধা হলো না তার।
অবয়বের দ্বিতীয় অংশ পড়শির ডিনারটেবিল থেকে
উঠে এসেছে অভুক্ত।সে বাড়ির লোকেরা এবং অন্নপূর্ণারা
ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করেছে খাবার।তাকে দেয়নি।মুখফুটে
সে চাইতে পারেনি।আধা অবয়ব-ওয়ালা তাকে যদি
প্রেতাত্মা বলে ভয় পায় তারা।
এবাড়ির দরজা অতিক্রম করার সময় রজনীগন্ধার
দেখা পেয়েছে। ঢুকে পড়েছে তার ঘরে।
#
৪)
ঘরে
ঘরে ঢুকেই সে পোশাক পরিচ্ছদের অশ্লীলতা
খুলে ফেলল।অবশ্য আয়নার কাছে সে সবসময়ই
নগ্ন।আবরণ বা আভরণ দিয়ে তার স্বাদ বাড়ানো
যায় না।
মেরুদণ্ড সোজা রাখার মতো একটা শক্ত বিছানা
টাঙানো ছিলো দেওয়ালে।অশীতির লাঠির মতো
দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে।ঘুম অপেক্ষায় ছিলো।সে
সোনারকাঠি ছুঁইয়ে দেয়।অবশ্য রূপকথার গল্পরা
নিজেদের আপডেট করে নিয়েছে।
অন্য অন্য ঘরে যে আমন্ত্রণগুলো জ্বলেছিল
তারা যেন সকলেই কিছু না কিছু পেয়ে গেছে।
মাছি, মৌমাছি, ফড়িং, পঙ্গপাল যেমনই হোক না
সার্কিট চেঞ্জ করে নিলে ,পাথরকে ঘড়ি আর
ঘড়িকে তস্কর বানানো বাঁ-হাতের খেলা।অবশ্য
সেসব খেলা যে তারা সবসময় বাঁ-হাতেই খেলে
তেমন নয়।
অন্ধকারও একটু চিত হবার জায়গা খুঁজছিল সেখানে,
কারো না কারো ঘরে পাবে নিশ্চয় একমুঠো ভাত।
#
৫)
ভাত
ভাত ছড়িয়ে দিলে মানুষের অভাব হয় না।দরকার হলে
হাজার অবয়বে ছড়িয়ে পড়তেও অরাজি নয় কেউ।সাতপাঁচ
চিন্তা নিয়ে একটা গোপন ড্রয়ারে হাত দেয় লোকটা।জানে
যদি একবার খোলা যায়, চিচিংফাঁক-মন্ত্র সে ভুলবে না।
মণিরত্ন যা ভেতরে আছে তারাও বেশ খুশি হবে তাকে পেয়ে।
ঘরের দেওয়ালে অনেক তাক আছে।তাকে তাকে কাঞ্চননগর
পাঁচমুড়া এবং ডোকরার দেবদেবীরা বিভিন্ন মুদ্রায়।যাকে সে
সর্বস্ব দেবার জন্য এসেছে, এখন তার সর্বস্বই ওকে ডাকাত বানাতে
চাইছে।অথচ ঘরে যে আলো জ্বেলেছিল, আলোতে মিশিয়েছিল
বিসমিল্লা, সে তার আবেদন নিয়ে পড়ে থাকলেও, ডাকাতের তাতে
ভ্রুক্ষেপ নেই।সংসারের বিচিত্রতা তার বিচিত্রতা দেখে
বাকযন্ত্র থেকে হাওয়া ।
এবাড়িতে অনেক ঘর আছে।ঘরে ঘরে বিভিন্ন রকমের খনিজ।
একটামাত্র ঘরের দিনলিপি লিখেই ক্যালেন্ডার খরচ করে ফেললে
হবে না।যথার্থ লম্পট হতে না পারলে পর্যটক হওয়া যায় না।
পর্যটকের হাতেই থাকে ডিসকভারি।
#
৬)
ডিসকভারি
ডিসকভারি শব্দটি কোথা থেকে এলো আর কার কার সঙ্গে
তার কেমন কেমন সম্পর্ক- সেসব নিয়ে লোকটার আগ্রহ
তীব্র ছিল না।ঠাকুরদার ডাইরি থেকে জেনেছিল, তাদের
একান্নবর্তী গুষ্টিতে বাড়ি ছিল একটা বাঁশঝাড়ের মতো।
সিংহদরজায় প্রহরীর এক কুঠুরি ঘর ছিল।ঢুকব
বললেই বাড়িতে ঢুকতে পারত না কেউ।প্রহরীর
নজর তার ভেতর বার তন্নতন্ন করে নিত।অনুমতি
মিললে পরবর্তী গন্তব্য ছিল বৈঠকখানা।সেখানে
ঠাকুরদা আর গড়গড়া ওষ্ঠলগ্ন হয়ে বসে থাকত।
ভেতর যে কতটা ভেতরে থাকত ,জানার বাসনা নিয়ে
লোকটা একদিন পালতোলা নৌকায় চেপে বসে।অজানা ,
অনির্দিষ্ট, ভয়ংকর জলপথ ,না শব্দটি ব্যবহার করত
প্রতিমুহূর্তে।এখন সেসবের পাট নেই।কেবল তুমি জাতীয়
পোট্রেটদের মত থাকলেই হলো।
হাজার অপরিচিত রহস্যের ম্যাসেজ এখন সুড়ঙ্গপথ ধরে
সরাসরি ঢুকে পড়ছে অন্দরমহলে।
#
৭)
অন্দরমহল
অন্দরমহল বিদায় নিয়েছে এখন বাড়ি থেকে।এমনকি
হাল্কা কালিতে যাব যাব করছে অভিধান থেকেও ।
একছাদের তলায় যে ড্রয়িংরুমের সোফায় তাকে
বসানো হয়েছে, সেখান থেকে সে পাশের কোনো এক
ঘরের ভেতরে, ভেতর-ঘরের পোশাক পরিবর্তনের
গন্ধ পাচ্ছে।গন্ধের গায়ে শব্দও লেগে আছে স্পষ্ট।
নজরকে একটু ঈগল করতে পারলেই বা পুলিশ-কুকুর,
অকুস্থল স্পষ্ট হয়ে উঠবে রাজপথে ।
চায়ের আতিথ্য পেয়ে বসে আছে লোকটা, কখন
মোনালিসা এসে পোজ দেবে।ড্রেসিংটেবিলের
আয়নার ভেতরে এক পরীও উদ্গ্রীব হয়ে আছে, কখন সে
অতিথির হাতে তুলে দিতে পারবে লকারের জেলিটাইপ হৃদয়।
কিচেন থেকে ভেসে আসছে সুস্বাদু রান্নার আদুল রেসিপি,
দুই অবয়ব এক করে বসে থাকা লোকটা ক্রমশ উশখুশ।
#
৮)
উশখুশ
উশখুশ করছিল লোকটার মন।জীবনবিজ্ঞান অনুযায়ী
হরমোন সেরকমই বলে।বাড়ির প্রত্যেকটা ঘরই তার
দেখতে ইচ্ছে করছে এবং স্পষ্ট অনুভব করছে , তারাও প্রত্যেকে
অধীর হয়ে উঠছে তার কাছে ব্যক্ত হতে চেয়ে।পাউডার, পারফিউম
পুরনো ও নতুন ন্যাপকিন, ব্রায়ের গায়ে লেগে থাকা
উষ্ণ ঘ্রাণ তাকে ডাকছে আড়াল থেকে।অথচ প্রত্যেকটা ঘরেই
মাকড়সা থাকার সম্ভাবনা শাস্ত্র অনুযায়ী।
কার কাছে, কেমন করে সে পঠিত হবে, কোষ্ঠীর অনুমানে
লেখা নেই। মনোবিদরাও নির্দিষ্ট কিছু বলতে পারে না।
হয় ইহা, নয় উহা- এই দোলাচল নিয়ে অভিধান ।
ইহার কাছাকাছি সমার্থক শব্দ মিলন, প্রাপ্তি, আস্বাদন।
উহা বলতে বুঝতে হবে উপেক্ষা, প্রত্যাখ্যান, অপমান,
এমনকি মানহানির মামলাও।
উশখুশ মানুষকে উস্কায়, অস্থির করে তোলে।কিন্তু
নিরাপত্তা দেয় না।আর যারা তাকে আইসক্রিমের লোভ দেখায়
তারাও বিপদ বুঝলে ক্যামেরার শাটার বন্ধ করে দেয়।
মুরগীরা এসব বোঝে।
#
৯)
বোঝে
বোঝে বলেই একটা লোকটা একটা বাড়ির সবটুকু
ঠিকমতো বোঝে না।যদিও সে জানে বাড়ির ভেতরের
দিকের দরজার অর্থ প্রবেশ।সে পথে কেউ
প্রস্থান করে না। তা করতে কেউ বলেও না।জানে
ভেতরের দরজা আরও ভেতরের দিকের ইঙ্গিত মাত্র।
লোকটা সে বাড়ির কলতলা ,স্নানঘর, মুখের উপর
কয়েক গাছি চুলে ঢাকা ব্যালকনি, সিঁডির ঘরের পাশে
প্রথম চুম্বনের ইমিউনিটি ক্ষমতার কথা জানে।তা হোক,
তবু সে উঁকিঝুঁকি মারতে পারে না।অপেক্ষা করতে হবে।
একটু একটু করে, একসময়, ফুলের সকল পাপড়ি
খুলে যাবে।তখন সম্পূর্ণটুকু তার।
একটা বাড়ির ভেতর যে কতগুলো ঘর থাকতে পারে
তা কেবল বাইরের লোকেই অনুমান করতে পারে।যারা
সে বাড়ির ভেতরে বসে বসে নিজেদের বয়স বাড়ায়, তারা
তো টেরই পায় না কখন ঘুলঘুলিতে এসে ডিম পেড়ে যায়
নিত্যদিনের চেনা পায়রাটি।
#
১০)
পায়রাটি
পায়রাটি এবাড়িতে এনে দেয় নিত্যনতুন আকাশ।
আকাশ মানে যে আলো, আকাশের আর এক
সমার্থক শব্দ অনন্ত, এবাড়িতে বলা নিষেধ ছিল।
শুধু বলা নয়, ভাবাও।তাই বিরাট একটা ছাদ দিয়ে
ঢেকে দেওয়া আছে বাড়ির উঠোন। সে নিষেধ
কে করেছে তা কেউ জানে না।নতুন নতুন চিঠি
আনতে জানে পায়রা, পড়তে জানে না।
চিলেকোঠার উপরে বসে থাকে সে।একদিন সে
একটা লোককে দেখেছিল এবাড়িতে ঢুকতে।সেদিন
থেকেই দেখছে এবাড়িতে প্রচুর গন্ধরাজ ফোটে।
গন্ধরাজ এমন এক শুভ্র নীরবতা যা মানুষকে প্রচুর
সাহস যোগাতে পারে।সাহসী মানুষদের খুব ভালোবাসে পায়রা।
একদিন এক ভোঁদড় এক মস্ত রুইমাছ এনে হাজির করল
বাড়িতে।সেই মাছের আমন্ত্রণে এবেলা ওবেলা একশো জনের
পাতা পড়ল।চিলেকোঠার উপর থেকে সব দেখতে থাকল
আকাশের প্রেমিক।
#
১১)
প্রেমিক
প্রেমিক জানে তার বুকই তার সবচেয়ে বড় শত্রু এবং সে জানে
বুকের অনুমোদন ছাড়া জল, পাথর কিংবা পায়রা, কেউই
তাকে চিনতে পারবে না।অনন্ত এক মৃত্যুকে জায়গা দিতে হবে
দিনে দিনে, তিল তিল পরিমাণ করে অণু-পরিধির বুকের ভেতর।
সবকিছু বর্জন করে ,অর্থহীন সন্ন্যাস নিয়ে, সে তোমাকে পাবার
ভান করেনি।জুঁই, বেলি, পানপাতা ও আমশাখার সঙ্গে
নালা-নর্দমা, মস-ফার্ণ সবকিছু থেকেই উঠে আসুক চাঁদের
পূর্ণিমা হবার চিরকালীন বাসনা।বৈদিক মন্ত্রের বোকামিতে
কাম, প্রেম কিছুই ধরা যায় না।চার হাত পা দিয়ে জড়িয়ে ধরার
নামই পরম নির্বাণ।
লোকটা যে কবি, চরম মূর্খ।ওকে প্রহার করার মতো সুখ
সংসারে আর কিছুতে নেই।চলো,ওকে জব্বর করে দিয়ে আসি
একটা ল্যাং।
#
১২)
ল্যাং
ল্যাং খেয়েছিল রাস্তায় প্রচুর।বাড়ি বাড়িও যে তার এতো
বিপুল আয়োজন, নিপুণ আয়োজন ,কে জানত! পাঁচিলের
বাইরে যে সব গাছেরা গলা উঁচু করে কৌতূহলী হয়েছে
তারা সকলেই এবাড়ির জিরে,পাঁচফোড়নের খবরও রাখে।
ছায়া সরিয়ে সরিয়ে, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত, দেখেছে
কার শরীরের উষ্ণতা কতটা।উষ্ণতা কমানোর জন্য
জলপটি সকলের ক্ষেত্রে কাজ করে না।কারো কারো তো
বিষে বিষে বিষক্ষয়ের ফর্মুলাও থাকে।সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত
কিছু জ্বালানি লাগে।
ল্যাং দিয়ে তাকে ফেলেছিল।তারপর বুকের উপরে ঝাঁপ
দিয়ে, যেভাবে জলে ডুবে মরতে যায় গ্রামের মেয়েরা, ঠোঁটের
কামড় দিয়েছিল সর্বাঙ্গে।মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গ
গোপন থাকতে পারে বলে, বিজ্ঞানের মতো, সেও বিশ্বাস
করে না।উন্মুক্ত করে দিলেই যৌনতার শালীনতা বজায় থাকে।
সৃষ্টির কলা-কৈবল্যকে ঢেকে রাখতে চাওয়াকে ক্রিমিনাল
অফেন্স হিসাবে বিবেচনা করা উচিত।
চেটে, চুষে, চিবিয়ে, পান করে খাওয়াকে আমরা খাওয়া
বলি না। বলি ভালোবাসা।
#
১৩)
ভালোবাসা
ভালোবাসা শব্দটি তাকে অনেককিছু বলার প্ররোচনা দেয়
অথচ সে কিছুই বলতে পারবে না।বাড়ির সম্ভ্রম বজায়
রাখার দায়িত্ব তাকে আগে পালন করতে হবে।শরীরে বিষ
ফোঁড়া জন্মালে, পাকলে, পুঁজরক্ত গড়ালেও বাড়ির কিছু
যায় আসে না।বাইরে থেকে ভেতর পর্যন্ত বাড়িতে যত মহল
আছে, তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নিয়ম।সম্পূর্ণ
সংবিধান ঠিকঠিক পালন হচ্ছে কিনা দেখার জন্য অনেক
ফোর্স আছে বাড়িতে।আগ্নেয়াস্ত্র মজুত আছে সঙ্গে সঙ্গে।
সমস্ত ক্রিয়াপদের কর্তারা যাতে ঠিকঠিক তা সম্পাদন
করতে পারে, কোনো বাধা-ব্যাঘাত না আসে, তাকে দেখতে
হবে।সে দেখে। রসুইঘর, ভাঁড়ারঘর, ঠাকুরঘরের মতো
এবাড়িতে একটি কেমিস্ট্রি ল্যাবের ঘরও আছে। সে দেখেনি
কখনো।অথচ জানে নিশ্চিত।একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ তার নাকে
আসে, আচ্ছন্ন করে, চৈতন্যহরণ করতে চায়।
বাড়ি বড় বিচিত্র এক জগৎ।প্রতিমুহূর্তে সে বাঁচিয়ে রাখে
আপদ থেকে দায়িত্ব নিয়ে।আখেরে খুন করাই যার উদ্দেশ্য।
#
১৪)
উদ্দেশ্য
উদ্দেশ্য নিজেকে নিয়ে হাজির হয়েছে তোমার দরজায়।ব্যক্তিগত
কোনো উদ্দেশ্য নেই তার।বিহীনতায় তার অস্তিত্ব।কেবল তোমার
শরীরের গন্ধ নিতে চায়।ডায়েরির পাতায় কী লেখো রোজ
গোপনতাকেও জানতে না দিয়ে, পড়তে চায়।নিজস্ব আকার
নেই তার।তাকে ধারণ করার দরকার হয় না।তোমার যে তিল
এখনো কেউ দেখেনি, তার স্পর্শ পেতে চায়।নিজস্ব শরীর
নেই তার।হাত নেই।আঙুল নেই।আঙুলের নখ নেই। নখের ভেতর নেই
আঁচড়ের খিদে।তবু সে তোমাকে নগ্ন করে চায় নগ্নতাকে
দূর করতে ।উদ্দেশ্য তোমাকে শুধু আত্মবাসা।
তাহার আকার নিয়ে কত গবেষণা পৃথিবীতে।কত অধ্যয়ন,
কত পরিশ্রম।পিছনে উদ্দেশ্য থাকে বলে উদ্দেশ্যর কেউ নাগাল
পেল না।তুমি তাকে চাও না, তাই, তোমাকে সে তীব্র পেতে চায়।
দরজা খোলো।প্রয়োজনহীন করে দাও দরজাকে।প্রসঙ্গহীনতার
হাতে হাত রেখে ঘ্রাণের শরীর থেকে নাও শুধু ঘ্রাণ।
#
১৫)
ঘ্রাণ
ঘ্রাণ নেমেছে রাস্তায়।অলিগলি পথে।গ্রামে ও নগরে।
নাক উঁচু করে, বেড়ালের মতো,কুকুরের মতো, খোঁজে।খুঁজে
নেবে গন্ধবতীকে।
প্রতিটি রাস্তার পাশে অসংখ্য বাড়ি।ছোটো ছোটো বাড়ি।কাঁচা
পাকা বাড়ি।প্রাসাদ পদবীধারী বাড়ি।এরই মধ্যে কোনো
একটা বাড়ি তার গন্তব্য।যে বাড়িতে গন্ধ নিজে বসে আছে সেজেগুজে,
ঘ্রাণের অন্তরে যাবে বলে।ঘ্রাণ তাকে খোঁজে।খুঁজে নেবে।
লোহাকে কঠিন বলে লোকে।কেবল চুম্বক জানে নৈকট্য হলেই
সাষ্টাঙ্গে আলিঙ্গন দেবে সেই লোহার নরম, কাদাকাদা,
মাখনের মতো প্রেম।ঘ্রাণ জানে গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা শ্বেত
আয়োজনে কেন মেতে থাকে।একাত্ম হবার কালে রঙ যেন ছলনা
না করে।
নাসারন্ধ্র থেকে ঘ্রাণ নেমেছে রাস্তায়।যোজনগন্ধার খোঁজে।
খুঁজে নেবে।ঘ্রাণের অন্তরে আছে তীব্র এক মিলনের রতি।
#
১৬)
রতি
রতি আর আকুল হয় না মদনের জন্য।মদনের প্রদ্যুম্ন-জন্ম
তাই আজ প্রয়োজনহীন।অ্যাপসের মাধ্যমে তার প্রয়োজন
নির্বাহ হয়।পারমাণবিক গঠন আর রাসায়নিক ধর্ম অনুযায়ী
উত্তেজনা।ধর্ষক-ভালোবাসা বিক্রি হয়।পেগ পরিমাপে সেবন দরকার।
রতি আর রতিপতির বাড়ি আলাদা আলাদা।এক রতি হরমোন
প্রযুক্ত হলেই বাড়ির সকল রহস্যে বসন্ত লেগে যায়।বাড়ি কোনো
ঠিকানা পরিচায়ক গুগল-বিন্দু নয়।অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশে তাকে
চিহ্নিত করা যায় না।
এক রতি পরিমাণ রতির প্রয়োগেই সুফল লাভ করা যায়।
লভ্যাংশ নির্দিষ্ট করা এবং একাউন্টে জমা করার সুব্যবস্থা
এখন আধার নম্বর দিলেই পাওয়া যায়।অথচ নির্বোধ রাস্তা
এখনো বাড়ির ঠিকানা খুঁজে খুঁজে আকুল।
#
১৭)
আকুল
আকুল হয়ে পোস্টম্যান খুঁজে বেড়াচ্ছে বাড়ি।বাড়িতে
যার থাকার কথা, তার চিঠির বাহক সে।যখন চিঠি
লেখা হচ্ছিল, ঘুম আসেনি তার।শব্দবাক্য জুগিয়েছে ।
খাতাকলম।চিঠির বয়ান।কতটা জল, কতটা মাটি
দরকার, কতটা রোদ, কতটা ছায়া, সে নির্দিষ্ট করেছে।
রাত শেষ হলো,চিঠি শেষ হলো।সকালে উঠেই লোকটা
চিঠি বিলির দায়িত্বপ্রাপ্ত পোস্টম্যান।ঠিকানার সঙ্গে চিঠিকে
মিলিয়ে দিতেই হবে।
কোন বাড়িতে কে থাকবে,কী তার নাম, চোখের মণির রঙ
কালো নাকি নীল, ঠিকানায় কিছু লেখা নেই।লেখা নেই
চুলের চরিত্রে সে কোনো দূর দ্বীপের পিদিম কিনা।
পোস্টম্যানকে দেখলেই সব বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
চিঠি প্রাপ্তির বিড়ম্বনায় কেউ পড়তে চায় না।দেবী না চাইলে
দেবতা তার সন্ধান পায় না।দেবী না চাইলে পোস্টম্যানও।
প্রেমের প্রতি দেবতার দায় নেই।পোস্টম্যানের বলি অনিবার্য।
#
১৮)
অনিবার্য
অনিবার্য ছিল একটা তুলসীমঞ্চ, একটা ঢেঁকিশাল ,একটা
গোয়ালঘর।অনিবার্য ছিল কিছুটা উঠোন।রঙের মধ্যে রঙ।
এখন আর তা নয়।
এখন অনিবার্য একটা সু-কেবিনেট।বাড়ির সামনেই একটা
সিঁড়ি।নিচে সিঁড়িঘর রেখে সে এঁকেবেঁকে উঠে যায় জায়গা
বাঁচিয়ে।দুএকজন বসার মতো একটা ছোট্ট ঘর থাকে।সোফা
থাকে। অ্যাকোরিয়ামের মধ্যে বন্দি-জীবন।প্লাস্টিকের টবে
বনসাই ।পোর্সেলিন ফুলদানিতে প্লাস্টিকের ফুল।নম্রতা
বিহীন রূপ।গন্ধ বিহীন রঙ।
বাড়িতে অনেককিছু ছিল।ছিল না আরও অনেককিছু।কিন্তু
অনিবার্য ছিল একটি অনাবিষ্কৃত মুখ।বুক ঢিপঢিপের মায়াবী
গন্ধ।অন্তত একটা বেড়াল থাকত, একটা কুকুর।একটা
কাঠবেড়ালি থাকত ,যাকে প্রত্যেক বাড়িতেই দেখা যেত
আম জামের গুঁড়িতে।
রাস্তা সেই বাড়ির জন্য ছিল পাগল। বাড়িও তার জন্য কতটা
উদ্গ্রীব ছিল ,কেউ জানত না।প্রতিরাতে ধর্ষিত হবার জন্য
মৌনতার ব্যায়াম করত একা।লক্ষ্মীর পাঁচালী।
#
১৯)
পাঁচালী
পাঁচালীতে যেমনভাবে তোমার বর্ণনা আছে ,বাড়ি তোমাকে
সেভাবে দেখেনি কখনো।অবশ্য এতে সম্পূর্ণ বাড়িটাই দায়ী
ছিল না।বাড়ির কোনো কোনো অংশ তোমাকে তোমার মতো
করেই দেখত।সেভাবেই তারা তোমার আয়নার কাজ করে দিত।
তুমিও পাঁচালীর তুমিকে চাইতে না।যে তুমির অম্বলে গলা জ্বলত,
তাকে তোমার পছন্দ ছিল বেশি। সদর রাস্তার ধুলো,
মুদির দোকান, উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকত তোমার দিকে ,
বাইরে যখন বার হতে।তারাও বুঝত পাঁচালীর ফাঁকিটা।অথচ
মুখ ফুটে কেউ তোমাকে বলত না গ্রামের লাইব্রেরিতে
আশাপূর্ণাদেবী কীভাবে ছিলেন।
এখন তো সদর অন্দরের পাট চুকে গেছে।একসময়, তোমার
প্রেমিক, তখন খুব ছোটো, আত্মহত্যা করতে তখনো পনের বছর
বাকি, সদর দরজা থেকে ডাক দিত বাহাদুর শাহ।নারায়ণের
সিদ্ধিটা তুমি তাকেই দিয়ে ফেলতে বারবার।
একদিন সব জানাজানি হয়ে গেল।পাঁচালী পুড়িয়ে ফেলল
ভক্তরা।বাড়ি গিলে খেয়ে ফেলল তোমাকে।উঠোনের
মাটি খুঁড়লে এখনো পাওয়া যাবে পবিত্র কঙ্কাল।
#
২০)
কঙ্কাল
কঙ্কাল এখনো জানে না সে কঙ্কাল।কেউ বললেও
মানতে চায় না।রক্তমাংস নেই তো কী হয়েছে ?দৃষ্টি ও কণ্ঠস্বর
নেই তো কী! ২০৬খানা হাড়ের ভেল্কি তো এখনো আছে।
এই হাড়ের ভেতরেই ছিল তার প্রেমিকসত্তা।এখনো অটুট।
ভালোবাসা বহন করতে গেলে কতটা কাঠিন্য প্রয়োজন ,
কতটা শক্তি রাখতে হয়, সে জানে।
কঙ্কাল বাড়িতে একা থাকে।অন্য কেউ সে বাড়িতে আসে না
কখনো।এমনকি সূর্যের আলোও সে বাড়িতে ঢুকতে ভয় পায়।
কঙ্কালের মাথা ব্যথা হলে টিপে দেবার কেউ থাকে না।জ্বর
আসলে কেউ তাকে প্যারাসিটামল দেয় না হাতে।বলে না -
ভয় নেই, সেরে যাবে।অন্ধকার একমাত্র বোঝে তার প্রেম
কতটা নিখাদ।
এবাড়িতে তার প্রেম যার জন্য ছিল অর্ঘ্যরূপে, কঙ্কালের সম্পর্কে
তার আগ্রহ নেই আজ।সে জানে জীবন মানে দলা দলা মাংস
আর ভয়ংকর রক্তের বোতল।হাড়ের ভেতরে কত বিশ্বাস ছিল
তারাই বোঝে না, যারা জীবনে অসংখ্যবার পুরস্কার রূপে পায়
মহার্ঘ্য প্রেম।
#
২১)
প্রেম
প্রেম আর প্রাসঙ্গিক নয় এবাড়িতে।আনাজের খোসার মতো
পড়ে আছে উঠোনের এক প্রান্তে।কাল আবর্জনা ফেলার গাড়িতে
তুলে দেবে।একটু সতর্ক হয়ে নিজেকে পাহারা দিতে হবে, যেন
কিছুতেই স্বয়ং না ঢুকে পড়ে ফাঁদের ভেতর।যেন প্রেমের জন্য
প্রার্থনা বা করুণা না প্রকাশ পায়।বিষধর সাপকে এড়িয়ে
চলতে হবে তার দংশন থেকে।মূল্যবান নীল বিষ যেন
সংগ্রহের নেশায় না ঢোকে।
ন্যাকামিতে, বোকামিতে জীবনের অপচয় না করে যেন কেউ।
বাড়ি খুব বিচক্ষণ।লক্ষ্য করেছে বহুবার এ রাস্তায় সে এসেছিল,
ঘুরে গেছে। প্রেমের শরীরে আজ মাছি, কীট, ঘৃণা দেখে খুব
তৃপ্তি পেয়েছে।
বাড়ির অভ্যন্তরে ,অনেকটা ভেতরে, বড় একটা গোপন ঘর
আছে।চলো, সেখানে গিয়ে, আগামীকাল কী কী মার্কেটিং হবে
ঠিক করে নিতে হিসাবশাস্ত্রকে।
তাকেও তো বুঝতে হবে, শিখতে হবে, শুভ বলতে ঠিক কী সম্পদ।
#
২২)
সম্পদ
সম্পদ রাতের তস্কর আর দিনের ডাকাত। শেখায় কীভাবে
তালা খোলার পাশওয়ার্ড পাবলিক করতে হয়।স্বাতী ,
নক্ষত্রই হোক বা একটি মেয়ের নাম, তার পরিচয়পত্রে
সূর্যকে আবশ্যিক রাখার আর কোনো প্রয়োজন নেই।
বাড়ির পিছনদিকে যে পুকুর ছিল, সেখানে আর
মুখ দেখা যায় না।কিছু চুরি গেলেই,চোরই যে তার
কারণ,মনে করতে হবে,সময় এখন আর ততটা স্বচ্ছ নয়।
খোলাচুলের আড়ালে যে বসে থাকে, তাকে বারবার
আপেল গাছের নিচে আসতে অনুরোধ করেছি।সে আসেনি।
এদিকে সময় ব্যাঙ্কে জমা রাখা যায় না।সুদে আসলে,
সরল বা চক্রবৃদ্ধি, কোথাও বেড়ে ওঠার সুযোগ নেই।
এক এক দিনে এক এক বছর ব্যয় হয়ে যাচ্ছে এখন।
বলো কীভাবে সব পাণ্ডুলিপি তৈরি করে যেতে পারব।
চোর ও ডাকাত, দুজনকেই ডেকে এনে বসাই,বলি-
একটু সময় ব্যয় করো আমার ক্যানভাসে।
#
২৩)
ক্যানভাস
ক্যানভাসকে বারবার কেউ অনুরোধ করে- বাড়ির একটা
ছবি আঁকো।বারবার সে একটা আশমান-প্রদীপের ছবি
তুলে দেয়।খুব বেশি পীড়াপীড়ি করলে সে তার অদূরে
একটা পায়রা এঁকে দেয়, যে উড়তে উড়তে উড়ে আসছে
সেই আলোর দিকে।
বাড়ি বলতে মানুষ কী বোঝে, ক্যানভাস কি জানে না? নাকি
সে জানে মানুষের সবরকমের বোঝা শুধু ভুল দিয়ে পুষ্ট।আর
সে প্রকৃতই যোগাযোগ রাখে বাড়ির আত্মার সঙ্গে।
রাতের অন্ধকারে সেই ক্যানভাসের দেহে অনেক আলো
জ্বলে ওঠে।তখন ওর পাঁজরের নিচে ফুসফুস, হৃদযন্ত্র আর
কিছু চুম্বনের দাগ এক একটা স্পষ্ট ম্যান্ডেভিলা।অথচ ওর
ধারেকাছে কোথাও কখনো কেউ রঙ,তুলি, চারকোল-কিছুই
রাখে না।তখন হয়তো ক্যানভাসের ভেতরে জেগে ওঠে
কোনো জন্মান্তর।
#
২৪)
জন্মান্তর
জন্মান্তর বাদ দিয়ে কিংবা জন্মান্তরবাদ নিয়ে বাড়ি
কোনোদিন মাথা ঘামায়নি।ভালোবাসা দিয়ে যত্ন সহকারে
চোখ অন্ধ করার পর,জন্মের পর মৃত্যু বলে, কোনো শব্দ
থাকে না।একবার যে জন্মায় সে থেকেই যায় বরাবরের জন্য।
এভাবে বাড়ির সদস্য সংখ্যা বাড়তেই থাকে।পোট্রেট আঁকার
চিত্রকর একটানা করে চলেছে সেই কাজ।
ঢেঁকিশালের পাশে, চট আর কাপড় দিয়ে খানিকটা জায়গা
ঘরের মতো ঘেরা ছিল।আঁতুড় ঘর।ইনফেকশন শব্দটা তখনো
বাংলার মাটিতে জন্মায়নি।একশো বছর পার হয়ে গেছে।সেই
জায়গাটা এখনো তেমনই আছে বাড়িতে।এখনো ব্যবহার হয়
অন্তত সরীসৃপের ডিম ফুটানোর কাজে।
ক্রম যেভাবে পায়চারি করে বাড়ির লম্বা করিডোরে তাতে ,
প্রত্যেকটি প্রসূতির জন্মদানের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়ে যায়
টাইপ রাইটার মেশিনে।সেই জায়গা এবং সময়গুলোকে মোটা
অক্ষর দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয়।প্রত্যেকটি সেকেন্ড সংগ্রহে রাখে
মনস্ক ইতিহাস।
#
২৫)
ইতিহাস
ইতিহাস চুপ করে বসে থাকে ইটের ফাঁকে ফাঁকে, চুনসুরকি বা
সিমেন্ট বালির মশলায়।মানুষ তাকে সব কথা বলতে দিতে
চায় না,আবার যে কথা তার নয়,বলাবার জন্য জুলুম খাটায়।
ইতিহাসের ভাষা বিভিন্ন রকমের।সেইসব রকমের উপর মানুষের
দখল নেই।আর মানুষের ছাপা অক্ষরগুলোকে ইতিহাস তেমন
একটা পাত্তাও দেয় না।
বাড়ির ইতিহাস বাড়ি জানে।যে চারশো স্কয়ারফুট ঘরে দাঁড়িয়ে
শহরের হ্যাটকোটেরা মিথ্যা ভাষণ দেয় সত্যের মতো করে, কাগজে
যা ছাপা হয় নানান রঙের অক্ষরে (অক্ষরদের ভাষাও ভিন্নভিন্ন)
সবই মিথ্যে শুধু নয়, ঠুনকোও।একদিন এখানেই প্রেম একাধিক
মানুষের উপাদান দিয়ে একাধিক মানুষ বানিয়েছিল।পাশেই ছিল
একটা স্টাডি রুম।সেখানেও কতদিন কত পাঠ্যবস্তু পরস্পরের মধ্যে
সঙ্গম ঘটিয়েছিল।
এখন এবাড়ির প্রত্যেকটি ঘরই খুব ছোটো এবং সেই ছোটো ঘরগুলো
ইট দিয়ে নিরেট করে ভরা আছে।সেখানে আর কেউ ঢুকতে
পারে না।অনেক টিকটিকি সেসব ঘরে মরে যাবার পর আজও
পালন করে চলেছে সত্যের ভাষণ।
#
২৬)
ভাষণ
ভাষণ অনৃত হলে তা যতই ঋতের পোশাক পরে থাক ,সত্য
হয় না।সিংহদরজা থেকে নাছদরজা পর্যন্ত সময়ানুক্রমে যে সব
ঘটনা ঘটে এসেছে এতকাল, তারা একে একে বেজে চলেছে
সময়-মেশিনে।বিশ্বাস তোমাকে পারেনি প্রমাণ দিতে তার
বিশ্বস্ততার।সন্দেহ দিয়ে তাকে তুমি পুড়িয়েছ বারবার।ভ্রান্তিও
বড় অবুঝ, সে বারবার খাদের কিনারে গিয়ে ঝুঁকি নেয়।তুমি তো
প্রেমের অর্থ খুঁজে পাওনি কোথাও।
উঠোনে মাটির উপর বসে আছে একটা লোক।তার মাথার উপরে
যে চাঁদের মেডেল ঝোলার কথা ছিল, এমন একটা উদ্ভট লোককে
সে উপযুক্ত মনে করেনি।
প্রতি রাতে,যে পেঁচা এবাড়িতে গাছের ডালে এসে বসে থাকে,
প্রত্যক্ষ করে অন্ধকার কীভাবে চুরি করে বাড়ির অতীত,সে কেবল
জানে ওই লোকটির অপেক্ষার সময় কত দীর্ঘ।
#
২৭)
দীর্ঘ
দীর্ঘ রাস্তা হেঁটে আসার পর এই বাড়ি।আরও দীর্ঘ
রাস্তা হাঁটতে হবে।আরও দীর্ঘ বন্যা সাঁতরাতে হবে।
দীর্ঘ দীর্ঘ মরুতে পুড়তে হবে।তারপর ফের এক বাড়ি।
বাড়িতে যারা ছিল,তারা আছে।যারা একদিন আসবে
তারাও আছে।কেবল এখন যারা আছে, পালাই পালাই
করছে।থাকার জন্য লড়তে হয়, ভুলে গেছে।বাড়িতে
এখানে ওখানে ভীমরুলের চাক আছে,গর্তে সাপ আছে ,
মাথায় ঠোকা, পায়ে হোঁচট আছে।জলবিহীন নলকূপ
আছে।লবণের স্মৃতি আছে।আছে উইকাটা কিছু বই।
পুরনো মৌচাকও একটা থাকতে পারে।
বাড়ি তোমাকে চেয়েছিল।বাসিন্দা ভূত হয়ে গেলেও
বাড়ি তাকে নিয়ে থাকে।একা পাশে বসে থাকে।ঠাণ্ডা
জলপটির আয়োজন নিয়ে থাকে।বাড়ি জানে শরীরে
তোমার কত তীব্র জ্বর।
#
২৮)
জ্বর
জ্বর গায়ে নিয়ে শুয়ে আছে এক বাড়ি।সে বাড়িতে
যার আসার কথা ছিল, এসে পৌঁছায়নি।এখন সে
কোথায়, কতদূর,পথিমধ্যে তার সঙ্গে কোনো বিপদ
দেখা করল কিনা- এইসব চিন্তায় ধীরে ধীরে
বাড়ির শরীরে খুব জ্বর।জ্বরের মাত্রা শরীরের সর্বত্র
সমান নয়।জ্বর তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সেও ।
যে মানুষটি আসার কথা ছিল - কেন এলো না,
যে মানুষটির ভালোবাসার কথা ছিল - ফুরিয়ে গেল কি,
কিছুকাল থাকার কথা ছিল -সময় খতম হয়নি তো,
ডাক্তারে এসবের জবাব জানে না।তাই বাড়িটির জ্বর
সারিয়ে তোলাও তার কর্ম নয়। জ্বরের সকল ভাষা
একজন ডাক্তারের পক্ষে জানা অসম্ভব।ডাক্তার তো
ভাষাবিদ নয়।
বাড়িটির জ্বর বাড়তে বাড়তে কি বাড়ার মাত্রা শেষ
হয়ে যাবে? জ্বর শেষ হলে উষ্ণতা কমে যায়।তখন
সে বরফ কেবল।বরফ না হয় যাতে,সেই মানুষটির মতো-
যার আসার কথা ছিল, সেজে কেউ একজন,তাকে
দাও ধোঁকা।
#
২৯)
ধোঁকা
ধোঁকা রান্না হচ্ছিল সেই বাড়িতে।তার ঘ্রাণ
ছড়িয়ে পড়ছিল, কখনো বাগেশ্রী ,কখনো বা
মিয়াঁ কি সারং।বাড়ির চতুর্দিক দিয়ে যত রাস্তা
গেছে, তারা সবাই গন্ধে গন্ধে এখানে এসে হাজির।
ভীষণ রকমের কোলাহল বেঁধে যায়।প্রত্যেকেই
ধোঁকা খাবার জন্য এবং আগে খাবার জন্য
যুদ্ধংদেহী।
কে সেই ব্যঞ্জন রান্না করছিল, সে আদৌ কাউকে
আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কিনা জানা যায় না।
সংবাদমাধ্যম কোলাহল আস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
জানে তাদের গ্রাহকরা কোন জাতীয় মাদক পছন্দ
করে।জল যেখানে নেই, সেখানে পৌঁছে দিতে হবে,
এসব থিওরি এখন চলে না।
বাড়িটি এখন এক উইঢিবিতে পরিণত। সেখানে
আর রান্নাবাড়া হয় না।লোকজনও ধারেকাছে নেই।
ভেতরে যারা আটকা পড়েছিল তারাও সকলে
কোমর, হাঁটু ও গোড়ালির ব্যথায় আক্রান্ত।
#
৩০)
আক্রান্ত
আক্রান্ত ফুসফুস জানত বাতাসে অক্সিজেনের অধিকার তার
কমে আসছে।প্রেম, একহাতে আঁকড়ে ধরে আছে একটুকরো রঙিন
কাপড়, মৃত্যু তাকে টানছে অন্য দিকের নড়া ধরে।যে সব অসমাপ্ত
চিঠি সে বাড়িতে ফেলে এসেছে, তাদের পরবর্তী লাইনগুলো লাইন
দিয়ে এগিয়ে আসছে দ্রুত।অথচ দুটো কালো বুড়ো আঙ্গুলের চাপে
গলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।মৃত্যু জিতিয়ে দেবার কেমিক্যাল তার
ঘামরক্তে ছিল না।মাথার ভেতর তবু কেন উৎপন্ন হচ্ছে কালো পিচ?
আক্রান্ত হৃদয় নিয়ে বেঁচেছে এতকাল।নাজুক প্রত্যাশা নিয়ে
টিকিয়ে রেখেছে গন্তব্য-বোধ।যুদ্ধ জয়ে সংশয় ছিল না কখনো।
জাগ-প্রদীপ জ্বালিয়ে এসেছে নিজ হাতে।ফুল গাছের ডালে
তুলির আঁচরগুলো টানা ছিল।এতদিনে তারা স্মিতমুখে আলোকে
ভরসা যুগিয়েছে ।
ফুসফুস হঠাত্ জেগে ওঠে।টানটান হয়ে ওঠে মেরুদণ্ড।ফাঁকা
সিলিন্ডারের লাইন লেগেছে তার বেডের দুধারে।অক্সিজেন ভরে নিয়ে
তারা ছুটছে আক্রান্ত বিশ্বাসের অলিন্দে।
#
৩১)
অলিন্দ
অলিন্দ শব্দটি বারবার বাইরের পথিক, পথ, গাছপালা ও
পাখি-পতঙ্গদের ভাবিয়েছে - তুমি একবার এসে দাঁড়াবে।
যুদ্ধবাজ-সৃষ্টি যারা এই সৃষ্টিতে, তারা যুদ্ধের কথাও ভাবে।
হার্টের শল্য-চিকিৎসকরা ,এর সুস্থতা বিষয়ে, উদ্বিগ্ন থাকেন।
কেবল সে বাড়িতে যে লোকটা একবার আতিথ্য পেয়েছে বলে
ভেবে নিত, ঘুমের অন্তঃকরণকে সুস্থতা দিত, সে জানত -
এটি একটি নৌকা বিশেষ।সে নৌকাটি যতই ছোটো হোক,
তার তুলনায় এক মহাসাগরও যে কত নগণ্য, সীগালরা জানে ভালোমতো।
সেই নৌকোর পোশাক যে বারান্দায় শুকাতো। সেখানে, রক্ত
তার CO2 ছাড়তে আর O2 সংগ্রহ করতে আসতো। সেজন্যই হয়তো
দূরদ্বীপের মেয়েটিকেও সেই বাড়ির অন্তরালবর্তিনী বলে মনে হতো।
বাড়িটি বা বাড়ির কোনো ঘরই ,কেউ দেখেনি। এক সাদা
পায়রার মুখ থেকে গল্প শুনেছে।
অলিন্দ বিষয়ক গল্পে যত গান আছে পৃথিবীতে, তা এক করলে
একটা বিরাট শামিয়ানা খুঁজে পাবে রামধনু।
#
৩২)
রামধনু
রামধনু উঠেছে বাড়ির নৈঋত কোণে। বাড়ির উত্তর প্রান্তে
একটি বকুল গাছ।দক্ষিণে একটি টেলিফোন টাওয়ার।এই
বকুল গাছ বা টেলিফোন টাওয়ারের সঙ্গে রামধনুর একটা
হাল্কা সম্পর্ক আছে।
টাওয়ারের সঙ্গে কৈশোরের বকুলমালার একটা রসায়ন আছে।
সে রসায়ন ক্রিয়াশীল হলেই রামধনু ওঠে।
লোকে বলে মতিচ্ছন্ন।
কখন যে একপশলা বৃষ্টি হয়ে যায়, তা কেউ খেয়াল করে না।
ভেজা ঘাসে পা ফেলার সুযোগ পায় না।কেউ কখনো দেখেনি
বৃষ্টি পড়ার সময় এবাড়িতে কোন কোন ঘরে কোন কোন রঙের
আলো জ্বলে।
রবিশঙ্কর কিছুটা জানতেন।কিছুটা বিলায়েত খাঁ।আর কিছুটার
দিকে চলেছেন বুধাদিত্য।একবিন্দু শিশিরকণায় ডুবে যায়
আস্ত একটা সূর্য। এ বাড়িতে তখন খুব তীব্র আলোড়ন।
#
৩৩)
আলোড়ন
আলোড়ন পড়ে যায় বাড়িতে এক এক সময়।সারা বাড়িতে
যতগুলো ঘর আছে তাদের প্রত্যেকেরই একটা করে বারান্দাও
আছে।প্রত্যেকেরই নিজ নিজ আলো, বাতাস আছে ভিন্ন ভিন্ন
রকমের।তাদের স্বাদ ,রঙ, গন্ধ প্রায় এক হলেও বাঁশির ধ্বনি
বা সেতারের ধুন অন্য অন্য ভাষায় চিঠি লেখে।
একজন তুমি দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেশবিন্যাস
করাকালীন সময়ে দেখে ,তার চুলের তেলের সুগন্ধের সঙ্গে
অগ্নিকোণের আকাশের এক নক্ষত্রের এক নরম বিক্রিয়া
ঘটছে। আলোড়ন বিষয়ক একটি কবিতার কথা তার মনে পড়ে।
সে আজ অবধি রচিত হয়ে না থাকলেও, রচনাকালীন সময়ের
একটা স্লো-মোশন ভিডিও নজরে আসে।
অন্য একজন তুমির কথাও সৃষ্টিতে থাকার কথা।হয়তো আছেও।
এবং প্রায় সকলেই জানে ,হয়তো শব্দটির ব্যবহারের বিপুল
বাড়াবাড়ির কথা। তবু সৃষ্টি তার রহস্যের অধিকাংশ রহস্যই
ঢেকে রাখে।সে চায় না সেসবের হোক উন্মোচন।
#
৩৪)
উন্মোচন
উন্মোচন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।ঘরে ঘরে দরজা জানালায়
যেসব পর্দা টাঙানো ছিল, তারা যদি একটু পাশে সরে দাঁড়ায়
আলো এসে ভেতরে ঢুকতে পারে।এবং তারা এও জানে, আলোকে
বেশিদিন বাইরে রাখা যায় না, যাবে না।
যে পাথরটিকে একটি চুম্বন দিয়ে এখানে রেখে গেছেন রামকিঙ্কর
সেও নিশ্চয় এতদিনে চুম্বন দেবার জন্য উদ্গ্রীব রয়েছে।আলো যেই
ঘরে এসে সেনিটাইজ করে বসবে চেয়ারে, তার নীল লজ্জার গায়ে
হলুদ রঙের ছোপ লেগে যাবে।
স্বপ্ন দেখার অনেক সাধ ছিল স্বপ্নের।কাছে পাবার সুযোগ হয়নি
এতদিন।উন্মোচন হবার সঙ্গে সঙ্গেই ছড়ানো বকুল ফুলের
নাকছাবির ঘ্রাণে ভরে উঠবে উঠোন।
বাঁশি কি এসব ক্ষেত্রে খুব জরুরি? কৃষ্ণের নয়, থিয়েটারের, হুইশেল
বলে যাকে।উন্মোচন আর ঘটনা খুব কাছাকাছি হলেই,গানের বাণীতে
সুর বসে যায় এমনিই।এক্ষুনি হবে সে ঘটনা।চলো, ছড়িয়ে আসি গোলাপজল।
#
৩৫)
গোলাপজল
গোলাপজল তৈরি আছে। স্নান করবেন নূরজাহান।আর
ভারত সম্রাট জাহাঙ্গির তাঁর কাপড়চোপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে
আছেন অদূরে। করোনা ভাইরাসের দাপটে তাঁর কোষাগার
শূন্য।গোলাম, বাঁদী সব ছেড়ে চলে গেছে।আমিরি বলতে
আর কিছুই নেই।শুধু এই আতরে-জাহাঙ্গিরিটুকু আছে।
আছে বেগম সাহেবার জন্য।সম্রাট তাঁর একমাত্র গোলাম।
বাড়িতে একাধিক হারেম ছিল,আপনারা জানেন।সেসব
এখন ফাঁকা।কিছু কঙ্কাল পাওয়া যাবে খুঁজলে। আলো ,
রোশনাই, যাকিছু ছিল এখন নেই।দুবেলা দুমুঠো ভাতই
জোটে না ঠিকঠাক।
গোলাপজল তো একটা স্বপ্ন।সেটা থাকবে না কেন?
টিকিয়ে রেখেছেন অতি কষ্টে।তবে হ্যাঁ, সেটা নূরজাহান
নাকি আনারকলি, কার জন্য,তা নিয়ে সম্রাট মুখ খোলেন না।
চতুর্দিকে একসঙ্গে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে একাধিক স্নানঘর।
#
৩৬)
স্নানঘর
স্নানঘর থেকে এইমাত্র সে গেছে ভিজে কাপড়ে।চতুর্দিকে
তার শরীরের ঘ্রাণের গন্ধ বিপন্ন করে তুলেছে বেলিফুলের
বাগানকে।সারা উঠোনে তার ভিজে পায়ের জলছাপ স্থায়ী হয়ে
থাকতে চাইছে লক্ষ্মীর দেমাকের মতো।এমন সময়েই আগন্তুক
ঢুকে পড়েছে বাড়িতে।চতুর্দিক নিস্তব্ধ।ভয়ের আবহের মধ্যে
মিশে আছে অপূর্ব মিষ্টি স্বাদ।কিসের ভয় সে জানে না।
বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছে।অনুমতি চাইবার মতো কেউ
কোত্থাও ছিল না।এখন যদি হঠাত্ করে সামনে এসে
হাজির হয় কোনো দশানন! অথচ ওই পদচিহ্নগুলো
এখন ওকে আরও ভেতরে যাওয়ার আমন্ত্রণ করছে।
বাড়ির ভেতরে, উঠোন ধরে হাঁটতে হাঁটতে, অভিযান এসে
পৌঁছায় এক পুকুরপাড়ে।বিরাট বড় এক দীঘি।জলে তার
যেন মিশে আছে এক দুর্বোধ্য বিদ্রুপ।একরাশ সিঁড়ি
নেমে গেছে পুকুরের বুক পর্যন্ত। গা শিরশির করে ওঠে।
বুকের ভেতর যে ঢেউ থাকার কথা, আছে নিশ্চয়ই, নাহলে
ওর পা কাঁপছে কেন!
পরদিন সকালে কাগজে পাওয়া গেল জলে ডুবে মৃত্যুর খবর
আকাশের।
#
৩৭)
আকাশের খবর
আকাশের খবর জানতে চেয়ে পোস্টকার্ড আসত
একসময় বাড়ির লেটারবক্সে।মহাকাশকে শুভেচ্ছা
জানানো চিঠিও যেত পোস্টকার্ডের হাত ধরে।
বাড়ির এক ঘর থেকে অন্য ঘরেও ছিল চিঠির
যাওয়া আসা।
এবাড়ির বাগান,পাশের বাড়ির বাগান পাশাপাশি
আছে বহুদিন।একজন আর একজনের দিকে
তাকালেই ঝাঁক ঝাঁক চিঠি যাওয়া আসা করে, যেন
সূর্যের আলো অসংখ্য আয়নার মুখে পড়ে প্রতিফলিত
হচ্ছে সরলরেখায় ।সেসব চিঠি যেতে যেতে, আসতে আসতে
গোলাপ, স্থলপদ্ম, দোপাটির রঙ গায়ে মেখে নেয়।
একটা অন্ধ, খঞ্জ, নিরক্ষর লোক আছে এবাড়িরই
এক মাকড়সার জালে।চিঠি পেতে,চিঠি পড়তে খুব
ভালোবাসে।ভালো ভালো কথা যদি কারো সংগ্রহ
না থাকেই,থাকলেও অপচয় করতে না চায়,আলতু
ফালতু লোকের জন্য, দরকার নেই ; গালাগাল,
ভর্ৎসনা, অভিশাপ দিয়েও যদি চিঠি ভরা থাকে,
তাইই থাক।চিঠি একটা পেলেই লোকটা শরীরে
পুষিয়ে নেয় ভিটামিন-ডি।
#
৩৮)
ভিটামিন-ডি
ভিটামিন-ডি প্রয়োজন হলে ঘর ছেড়ে বাইরে আসে।উঠোনে
বসে মোড়া পেতে।ঘাড় গুঁজে থাকে মাটির দিকে।মেরুদণ্ড
বেঁকে গেছে। সোজা হবার ক্ষমতা নেই।মাটির গন্ধ লাগে বলে
নাকে চেপে থাকে কাপড়।মাথার উপর আকাশে যে আকাশ
আছে ,জানতে পারে না।পাঁচিলের বাইরে চতুর্দিকে অনেকগুলো
দৌড় অনবরত দৌড়াচ্ছে।রাস্তার শরীর থেকে প্রতিদিন
নতুন নতুন তেউর বার হয়, বড় হয়।জলের নিচ থেকে
মৎস্যকন্যা উঠে এসে পক্ষীরাজের সঙ্গে বেড়াতে যায় রোজ।
এসব সে কিছুই জানতে পারে না।গাছের ছায়া একটু ছোটো হলেই
জলতেষ্টার হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরে ঢুকে যায়।
অন্ধকার আশ্বস্ত হয় তাকে ফিরে পেয়ে।
অথচ একদিন,বহুবছর আগে,এই শহরেরই একটা মানুষ
ভিটামিন-ডি সংগ্রহের জন্য তার দর্শনপ্রার্থী হতো। সে তখন
ঘরের নীল আলো ছেড়ে বাইরে আসত না।লোকটাকে সে
ঘৃণাও করত ভিখারী বলে।
গোটা বাড়ির প্রত্যেকটি দেওয়াল এখন কান্না জমিয়ে জমিয়ে
পাথর করে।পাথর কেটে কেটে সিংহাসন বানায়।অপেক্ষা করে
একজন ভিখারীর জন্য, শারীরিকভাবে।
#
৩৯)
শারীরিকভাবে
শারীরিকভাবে পেতে চেয়েছিল এবাড়ির একটি ঘরের এক
জিরো পাওয়ারের বাতি।শারীরিকভাবে দিতে চেয়েছিল এবাড়ির
একটি ঘরের রজনীগন্ধা নামের এক ধূপ।এভাবে দেওয়া এবং
নেওয়া নাকি এক গর্হিত কাজ।এরকম মনে করত অন্য ঘরগুলো।তাই
তাদের সংগ্রহে থাকা দেওয়ালগুলো ওদের সামনে এনে পরপর
দাঁড় করিয়েছিল।দেওয়াল নির্মাণের পাঠ্যবস্তুতে ভালোবাসা
লেখার জন্য কোনো বর্ণ বা লেটার দেওয়া থাকে না।
সেইসব ঘরেরা হয়তো শরীরবিহীন কোনো সিলেবাস পড়েছিল।
অথচ এবাড়ির চাঁপা গাছটি বুঝেছিল বাগানবাড়ির আমলকী
গাছটির সঙ্গে ওর পরিচয় সম্ভব হতো না ,যদি না তাদের ছায়া
দক্ষিণের দিকে গিয়ে দেখা করত।
অন্য গ্রহ থেকে আসা দ্রুতগতির একটা ট্রেন ছুটে গিয়েছিল ।
কেঁপে উঠেছিল এবাড়ির সবঘরের ভিত। পরস্পর পরস্পরকে
শরীর দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল।সেদিন কল্পনা তাদের বলে গেল
অকল্পনীয় স্বপ্নেরও কিছু বীজ থাকে, খোসা থাকে, থাকে শূন্যস্থান।
#
৪০)
শূন্যস্থান
শূন্যস্থানের মধ্যে বসেছিল অবয়বহীন খানিকটা সময়।ভাবছিল
কে, কবে, কখন এবাড়িতে এসেছিল।কবে, কীভাবে, কোন গাছে
ফুল এসে বসেছিল, ফল এসেছিল।কীভাবে ঝড়ের আঘাতে একা
ভেঙে গেছে এক বনস্পতি।বাজ পড়ে পুড়ে গেছে সুন্দরের রূপ।
এঘরে ওঘরে চলাচল করত যে নূপুর, সদর থেকে অন্দর
পর্যন্ত সরলরেখায়র মতো বিচরণ করত যে কণ্ঠস্বর ,তারা
একদিন, কোনো কারণ না দেখিয়েই, অন্তহীন লম্বা ছুটিতে
চলে গেল।এরকম সাত পাঁচ চিন্তা সময়ের।
শূন্যস্থান একরকমের ক্যান্সারের মতো।নিরীহ বেড়ালের মতো
বসে থাকে মাছ-ভাত ,দুধ-ভাতের আশায়।হঠাত্ একদিন সেই বেড়াল
বাঘ হয়ে যায়।মানুষ খেঁকো বাঘ।সময় খেকো বাঘ।বাড়ির প্রত্যেক
ঘর ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে বসে থাকল।জানালা খুলে দেখার সাহস
টুকুও পেল না ।
সিঁডিরঘর থেকে একদিন নেমে এলো বাড়িরই এক কর্তা।
মাটিতে খুঁড়ে খুঁড়ে পুঁতে রাখা ভালোবাসাকে তুলল।জলে ধুয়ে
দেখতে থাকল।দেখতে চাইল প্রেমের বীজ জীবিত না মৃত।
#
৪১)
মৃত
মৃত স্বপ্নেরা আজও এবাড়ি ছেড়ে বার হতে পারেনি।চায়ও না।
মাকড়সার জাল, পায়রার খসে পড়া পালক, টিকিটিকির
ডিমের ভাঙা খোসা এবং কয়েক হাজার বছরের পুরনো কোনো
সাপের খোলস, মৃত্যুর লালাসিক্ত ভালোবাসা মেখে
পড়ে আছে।প্রাচীন অশরীরীদের প্রেম ,যাকে অনেকেই
ভূতের গল্প বলে চালায়, এবাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে
স্যাঁতা দাগের মতো লেগে আছে।
দেউড়ির বাইরে থেকে যে দৃষ্টি ঢুকতে চেয়েছিল এবাড়ির
গভীরে, গোপনে; স্বর্ণপদক প্রাপ্ত শুক্রাণুটির মতো একা
সে আজও বাড়ির চতুর্দিকে কালো বেড়াল হয়ে ঘুরে বেড়ায়
কেঁদে কেঁদে।মৃত্যু এদের প্রাণ কেড়ে নিয়েও মারতে পারেনি।
পৃথিবীর প্রথম মানুষটি যেদিন মারা গেল, এবাড়িতে সেদিন
অরন্ধন পালিত হয়েছিল যৌবনভরা পদ্মপাতায়।
#
৪২)
পদ্মপাতায়
পদ্মপাতায় এসে আশ্রয় নিয়েছে জাগরণ।ঘুমের প্রস্তুতি
নিচ্ছে।না ঘুমালে ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যের সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষ হয় না ।
জাগরণ এখন পুরোপুরি নগ্ন।তার নগ্নতার সৌন্দর্য মেখে
মৃণালের লাবণ্য জলকে দিচ্ছে স্বচ্ছতা।বহু রাস্তা জীবনভর
হেঁটে এসেছে জল।এবাড়িতে এসে একটু বিশ্রাম নিতেই নাভিকুণ্ড
থেকে উঠে এসেছে এই পদ্মগাছ।বাড়ির সবাই এখবর পায়নি।
কারণ তারা কেউই ছবি আঁকার জন্য ক্যানভাসের সন্ধানে ছিল না।
কেবল একজন আড়-পাগলা লোক, সম্পূর্ণ জীবন না পাওয়া,
পদ্মগোখরোর ছোবলের অপেক্ষায় থাকে।
অহ্নের মধ্যভাগে এসে পৌঁছালে সেই পদ্মপাতার উপর বসে
মাধুকরীর অন্নকে আহার্যের মর্যাদা দেয়।হয়তো লোকটা
একবার চিন্তা করেছিল সে সিদ্ধার্থ থাকবে নাকি গৌতম নাকি
ক্যামোফ্লেজ করবে তথাগত রূপে।বাড়ির কেউই অবশ্য তাদের
শরীরী জ্যামিতির প্রকাশ ঘটিয়ে তার উন্মাদাত্মাকে পাত্তা
দেয়নি।কেবল পাঁকের মধ্যে নিজেকে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করছিল
অপূর্ব সুন্দরী এক মৎস্যকন্যা।
#
৪৩)
মৎস্যকন্যা
মৎস্যকন্যার এখন চুল আঁচড়াবার সময়।সূর্য এসময়
কোনোদিনই তার কাজে ফাঁকি দেয় না।তার সমস্ত আলোটুকু
ওই কন্যার জন্য বরাদ্দ করে।বাকি চরাচর ঢেকে দেয় মেয়েটিরই
খোলা চুলের ঢাল।
এমনই একদিন,ওর চুল আঁচড়াবার সময়ে, অভিযান এসেছিল
চুম্বকের প্ররোচনা না বুঝে ঝাঁপ দিয়েছিল জলে।বাড়ির
লোকেরা সে ঘটনা কেউ জানত না।ভোরের এক কাক
আবিষ্কার করেছিল জলের উপরে সেই লোকটির ভাসমান
শবাসন। আর পাঁচটা কাক-মুখের গল্প যেমন হয়।
আজ আর একজন প্রেমিকের শহিদ হবার শুভক্ষণ।এবাড়ির
গাছপালারা ইদানিং কেন ক্লোরোফিলের অভাবে ভুগছে,
জানার জন্য, জলে ঝাঁপ দেবে বেচারা। তিনতলার এক রান্নাঘর
থেকে একজোড়া আয়তলোচন অবশ্য এখনই এই জলাশয়ের
দিকে আসছে।হাতে তার মোবাইল টর্চ।এই প্রেমিকের মৃত্যু
রদ করে সে আজ বুঝে নেবে কীভাবে হতে হয় প্রকৃত প্রেমিকা।
#
৪৪)
প্রেমিকা
প্রেমিকা ছিল একজন এবাড়িতে।পূর্বদিকের একটি ঘরের
এক যুবককে সে ভালোবাসতো।সংসার করত পশ্চিম দিকের
আর একটি ঘরের এক বৃদ্ধের স্বর্ণমূর্তির সঙ্গে।যত ভালোবাসা
তার বুকের মধ্যে ফেনিয়ে উঠত, শরতের নীল আকাশের গায়ে
এখনো দেখা যায়।সেসব ভালোবাসা এখনো এই বাড়ির
চতুর্দিকে, নলকূপের আশেপাশে,কুয়োতলার ভিজে মাটিতে
শুশুনির শাক হয়ে জন্মায় ফুলের মতো।
প্রেমের গল্পে যেরকম হবার কথা, ওদের দুজনের মাঝে
উঠোনকে সমৃদ্ধ করে একটা যমুনা ছিল না।দুজন দুজনকে
যখন ভালোবাসতো, বাড়ির গাছপালারাও টের পেত না।
প্রেমিকার সব ভালোবাসা চেটেপুটে খেত সেই বৃদ্ধ।আর
ছেলেটির বুক রেলের চাকায় কেটে যেত। এরকম হাল্কা
প্রেমের গল্প এবাড়িতে কোনোদিন লেখা হয়নি।
আসলে এবাড়িতে কোনোদিন কোনো প্রেমিকা ছিল না।
কেবল বিভ্রান্ত এক হাওয়ার ঘূর্ণন এলোমেলো করে দিত
ইতিহাস লেখার সব অমৃত অক্ষর।
#
৪৫)
অক্ষর
অক্ষর নিয়ে কাজ করে একজন এবাড়িতে।অবিরাম,
সারাদিন রাত সে অক্ষরের গায়ে অক্ষর বসায়।লোকে
এসব লোককে বলে অক্ষরজীবী।এবাড়িতে অক্ষরগুলোই কিন্তু
তার স্পর্শে জীবন পায়।
বাড়িতে যে কয়জন মানুষ আছে তারা সবাই কথা বলে।
কেউ কম,কেউ বেশি। সেসব কথা সে সংগ্রহ করে।
কথাগুলোকে অক্ষরের শরীর দেয়।পশুপাখিদের কথা,
জড় বস্তুদের কথাও লিখে রাখে।
একটা ঘর বাড়িতে আছে।ভূতের ঘর।সে ঘরে কেউ যায় না।
আলো, বাতাসও সে ঘরে যেতে ভয় পায়।কেবল সেই
অক্ষর-বৎসল মানুষটি সে ঘরে যায়।থাকে সেখানেই।
রাজ্যের মানুষের কথা, শব্দ, বাক্য কাঁধে করে বয়ে বয়ে এনে
জমিয়ে রেখেছে ঘরের ভেতর।অক্ষরে ধারণ করা সেইসব
ধ্বনি একদিন লোকটার বুকের উপর চেপে বসবে নির্মম পাথর।
৪৬)
পাথর
পাথর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় যতটা সম্মান পেয়েছে
এবাড়িতে তার চেয়ে কম নয়।পাঁজরে পাঁজরে পাথর ঠাসা আছে।
রক্তের মধ্যে আছে তরল পাথর বেশ সমাদরে।গন্ধের জন্য আতর
এতটা আদর পায়নি কোথাও,এবাড়িতে পাথরের নারীমুর্তি
যতটা পেয়েছে।
ঠোক্করে, হোঁচটে ,নিক্ষেপে শুধু নয়, ডৌল স্তনের ডাক, পুরুষের
পেশি আর চোখের দু-কোণ বেয়ে ঘৃণার বল্লম,নরম পাথর
দিয়ে নির্মিত হয়েছে বহুবার।
শুকিয়ে যাবার আগে ফুল টের পায় পাথর কত তৃষ্ণার্ত।
গড়িয়ে যাবার আগে জল শুনতে পায় তার বুকের ভেতর ঝর্ণার
ঝরঝর ধ্বনি।রাত্রি তাকে ভালোবেসে যত স্বপ্ন পায়, দিন
তার অধিক পায় বিশ্রামের বুক।
এবাড়িতে উনিশ নামে এক মেয়ে ছিল।পাথরকে সে একদিন
নিয়ে গিয়েছিল ছাঁদনাতলায়।
#
৪৭)
ছাঁদনাতলা
ছাঁদনাতলা থেকে বেঁধে নিয়ে গেল এক দৈত্য। প্রেম কাউকে
বাঁধে না।ফুল ফুটিয়ে, রঙ নিয়ে ,গন্ধ ছড়িয়ে বসে থাকে।কখন
সে স্বেচ্ছায় জল নিতে আসবে, অপেক্ষায় থাকে।অপেক্ষাই সার তার।
হরিণ হরণ ভালোবাসে।ভালোবাসে দংশন, নিষ্পেষণ।গলায়
বগলস ভালোবাসে।পাথরের নিষ্প্রাণ দেহে সে তার সোহাগ
অপচয় করে সুখ পায়।প্রেম তার কাঙ্খিত নয়।
ডাকাত যখন তাকে চুরি করে নিয়ে গেল, পথের দুধারে
শালুক, পদ্মের দীঘি দেখেছিল।যেভাবে চলন্ত ট্রেন চলে যায়
উদাস যাত্রীর দৃষ্টি অস্বীকার করে। প্রেমিক বোঝেনি নারী
চুরি হতে ভালোবাসে।অধিকার , সম্মান নয়।
প্রেমিকের শ্বাস এই বাড়ির বাতাসে ব্লটিংপেপার হয়ে ঘোরে।
আর্দ্রতা শোষণ করে।উত্তাপ ধরে থাকে নিজের নাড়িতে।
একটি শালিক শুধু একাএকা, নির্দিষ্ট মনের ব্যয়ে দেখে
এক দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা কালো ক্যালেন্ডার।
#
৪৮)
ক্যালেন্ডার
ক্যালেন্ডারগুলো ঝুলছে ঘরে ঘরে।এক একটা পেরেক
পঁচিশ তিরিশটা বছর ঝুলিয়ে রেখেছে।জন্ম আছে।শৈশব,
কৈশোর,যৌবন আছে একএকটায়।প্রথম চুম্বনের স্বপ্ন আছে।
বুকের ধক-ধক ,পতনের শীৎকার আছে।লাল কালিতে
চিহ্নিত আছে নিবেদনের ক্ষণ।প্রত্যাখ্যানের দিনটিও আছে
কালো মেঘে ঢাকা।
ফ্যান ঘুরলে বা খোলা জানালার মন বিন্দাস থাকলে
ক্যালেন্ডারগুলো দুলেছে বার বার ।ঘুরেছে।ঘুরতে ঘুরতে
দেওয়ালে একটা একটা নিখুঁত বৃত্ত এঁকে ফেলত।সেইসব
বৃত্তের দাগ এখনও দেওয়ালে দেওয়ালে আছে।যেন দ্য ভিঞ্চি
কিছু আঁকতে চেয়েছিলেন কখনও।
প্রত্যেকটা ক্যালেন্ডারের পাশে একটা করে পিয়ানো আছে।
পিয়ানো হলো কথার ছবি তোলার ক্যামেরা।কত কথা সে
বর্ণহীন সোনার জলে লিখে রেখেছে, জানে আগামী শতকের
এক উপন্যাস।
#
৪৯)
উপন্যাস
উপন্যাসের শুরুতে তার কথা ছিল না।শেষেও ছিল না।
রাস্তার কেউ তাকে চেনে না এ বাড়ির লোক বলে।সদরে
খোঁজ করলে সিকিউরিটি বলতে পারবে না।বাড়ির
নাম-ফলককে যদি জিজ্ঞাসা করো, মুচকি হাসবে।
হঠাত্ একদিন শক্তির আরাধনার শখ হলো বড় কর্তার ।
সব আয়োজন সম্পন্ন হলো।শক্তি পুজোয় বলিদান তো
করতেই হয়।তখন একবার তাকে উপন্যাসের একটি দৃশ্যে
আনা হলো।খোশামোদ করা হলো খুব।সেও নিজেকে
রাজা-রাজা ভাবতে শুরু করল।তারপর সবই মহাশক্তির ইচ্ছা।
বাড়িতে খুঁজলে,এঘর ওঘর করে,অনেকগুলো অ্যালবাম
পাওয়া যাবে, সাদাকালোর যুগ থেকে রঙ দেখানোর
সময় পর্যন্ত। সমুর একটা ক্লিক-থ্রি ক্যামেরা ছিল।সে যুগে
সঙ্গে একটা ক্যামেরা থাকা চাট্টিখানি কথা নয়।কার না
ছবি উঠেছে সে যন্ত্রটায়! কেবল ওই একজনের ছবি,
ছিল না বলা যাবে না, ছিল ওই বলির চূড়ান্ত সময়ের।
তারপর তো কত নামীদামি ক্যামেরা এলো।মোবাইল এলো।
দামি দামি অ্যান্ড্রয়েড এলো।দামি দামি ফটোগ্রাফারও এলো।
সেইসঙ্গে প্রচুর সেল্ফি। তার কথা আর একলাইনও নেই উপন্যাসে।
বাড়ির মালখানায় এখনও পড়ে আছে সেই হাড়কাঠ।
#
৫০)
হাড়কাঠ
হাড়কাঠ কথাটা প্রকৃতপক্ষে নাকি হাড়িকাঠ।কত প্রকৃতকেই তো
এবাড়ির লোকেরা চিনত না, জানত না।এই গতকালই যেমন
কথা হচ্ছিল ছাতনাতলা নিয়ে।কথাটা সঠিক না জানায় কত
কথাই শুনতে হলো তাকে।শুনতে হলো সে আস্ত একটি অশিক্ষিত
প্রাণী।এ কথা বলেছিল একজন শিক্ষিত মানুষ।কারণ ছাতনাতলা
কথাটা যে আসলে ছাঁদনাতলা, সেটা সে জানে।অশিক্ষিত সেই
প্রাণী তো অবাক! ছাতনাতলা বলতে বলতেই তো কম করে
পঞ্চাশটা ছেলেমেয়ের পার হয়ে যাওয়া দেখল জীবনে।
সেই হাড়িকাঠ এখনও এবাড়িতে দিব্যি রয়ে গেছে।সর্বাঙ্গে রক্ত মেখে
সে অটুট।অন্য বাড়ির নারীপুরুষরা রোজ নিয়ম করে পুজো করতে
আসে।ফুল, বেলপাতা, ধূপ এবং খুচরো পয়সায়।তেল সিঁদুর মাখায়।
হাড়িকাঠ কি স্ত্রী লিঙ্গ? সংসারে এক কৃষ্ণছাড়া বাকি সবই প্রকৃতি
অর্থাৎ নারী।আর যূপকাষ্ঠ তো মা কালির নোলা ।
এবাড়ির কৃষ্ণ এখনও কি পা দোলায় কদম ডালে?
#
৫১)
কদমডাল
কদমডালে বসে আছে লোকটা কোন অভিপ্রায়ে! এগাছের
ডাল কিন্তু খুব শক্ত নয়।যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে।
গাছের নিচে বাড়ির মালিক গর্ত কেটে রেখেছে।এ গর্তে যে
পড়ে, তাকে উদ্ধার করার মতো উদ্ধারকর্তা, এখনও কল্পনায়
আসেনি।
কদমফুলের বহুমাত্রিক রূপ, প্রথম কে কাকে তুলে দিয়েছিল
হাতে ,নিজের বুকের ভেতর থেকে উপড়ে নিয়ে? সেই বুকেও একটা
বিরাট গর্ত হাঁ-হাঁ করছে। অতি সাবধানে পার হতে হয় সে রাস্তা।
যেভাবে পতঙ্গভুক ফুলের প্রেম এড়িয়ে চলে পোকামাকড়েরা।
এবাড়িতে এক মকবুল ছিল।গজগামিনীর চোখে পা দিল
একদিন।সে চোখের তীব্র প্রাণঘাতী বিষ তার শরীরে ছড়িয়ে
পড়ল।মারা গেল মকবুল।মারা যাবার পর যে মকবুল
বেঁচে উঠল, সে এখন জানে, প্রেমিক অমৃতের পুত্র।
#
৫২)
অমৃতের পুত্র
অমৃতের পুত্র এবাড়ির দেওয়ালে ঝুলে আছে।হাতে পায়ে তার
পেরেক পোঁতা আছে।প্রতিটি ক্ষতস্থান থেকে টসটস
ঝরে পড়ছে ভালোবাসা।বাড়ির প্রতিটি মানুষ এসে নতজানু
বসেছে সেই ডেডবডির সামনে বাপ্তিস্ম প্রার্থনা করে।দেওয়ালটা
যেহেতু বাড়ির বাইরে, পথচারীরাও যেতে আসতে নিজ নিজ বুকে
ক্রুশ চিহ্ন আঁকে।
অমৃতের রক্তাক্ত পুত্র ঝুলে আছে অনন্তকাল।ভাপা ইলিশ ,
চিকেন পকোড়া খাওয়া মানুষেরা তাকে ফুল দেয়, ধূপের
ধোঁয়া দেয়।কেউ কেউ গোটা গোটা আপেলও রাখে পায়ের কাছে।
ভালোবাসা দেয় না কেউ।
ভাদ্র-লালসায় আক্রান্ত এক কুকুরী তার যোনি-ক্ষতের তাড়স
উচ্ছুগ্গু করতে এসেছে।অমৃতের পুত্র তার পেরেক বেঁধা হাত বাড়িয়ে
পরিবেশন করছেন প্রেমের আরোগ্য।
#
৫৩)
আরোগ্য
আরোগ্যের পথ চেয়ে বসে আছে এই বাড়ি।প্রত্যেকটি ঘর।
ঘরে ঘরে জানালা তার গৃহবন্দি আত্মজন সহ।কেউ যেন
আসছে বহুদূর থেকে।দূরবিনকে সে কথা বলেছে এক সচল
বিন্দু।সেই বিন্দু , যে ক্রমে সিন্ধু হবে। এ বিশ্বাস এবাড়ির প্রত্যেকের
কাছে আছে যথেষ্ট পরিমাণে।
লক্ষ লক্ষ পচা বুক, নষ্ট মস্তিষ্ক, অচল স্নায়ু আর বাঁকাচোরা হাড়
চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে।দূষণ একমাত্র বন্ধু তাদের।তারা
বাঁশি পছন্দ করে না।ভয় পায় ষড়যন্ত্রকে।তাহাদের বাঁ হাতের
আয়োজিত কুকর্মের রাশ এবাড়ির বাতাসকে করেছে হত্যা।
আলোর গায়ে লাগিয়েছে কালি।মাটির বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে
অন্ত পর্যন্ত শ্বাস।
আরোগ্য তবুও এবাড়িতে আসবে সকলকে চিকিৎসা দিতে।
আবার সচল করবে সকলের নাড়ি ।দূরবিন কথিত সেই বিন্দুটি
অনতিবিলম্বে হবে প্রাণে ভরা মহাইউনিভার্স।
#
৫৪)
মহাইউনিভার্স
মহাইউনিভার্স থেকে তুমি ফিরে এসো কাছে।এবাড়ির
মৃতবৎসা গাভিটিকে দাও তোমার দুহাত ভরা আদরবাসা।
এবাড়ির হাওয়ায় যে মুরুঞ্চে ঘ্রাণ লেগে আছে ইদানিং,
দূর করো।জলাশয় থেকে সেই মৎস্যকন্যাকে ডেকে আনো,
বরণ করো পুত্রবধূ করে।ছেলেতে ও বৌতে যেন ভালোবাসা খুব
ঘন ও খাঁটি হয়ে ওঠে।ভেজাল ক্ষীরের তৈরি বদনাম দূর করে।
নক্ষত্র অযুত থাক।তারা যদি স্বীয় শৌর্য ও অহংকারে দূরবর্তী
থাকে, থাক।তুমি ফিরে এসো মহাকাশ।বাড়ির উঠোনে
না এলে, যোজন-আলোকবর্ষ-পরিধির ভূমিও খুব ছোটো
হয়ে যাবে।হাঁপিয়ে উঠবে তুমি।
একটি নয়নতারা ফুল তুমি দেখেছিলে এবাড়িতে।মুগ্ধ
হয়েছিলে।ভালোবেসেছিলে।এখন সে নয়নতারা আর এক
সখীর সঙ্গে ষোড়শী হয়েছে।পুটুস তাহার নাম। গলায়
গলায় তারা। একগ্লাস জলেই তৃষ্ণা মেটে দুজনেরই।এসো
বন্ধু হয়ে। বসো এই মাটিতে তাদের পাশে, বিপিনবিহারী ।
#
৫৫)
বিপিনবিহারী
বিপিনবিহারী এবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে বহুকাল আগে।
যে রাধার সে মাধব হতে চেয়েছিল,তার নিজেরই এক ভাই
সে রাধাকে ঝেঁপে দিয়েছে।এখানেই থেকে, কড়িবরগা থেকে
একদিন ঝুলে পড়ার চেয়ে সন্ন্যাস নেওয়াই শ্রেয় হবে
মনে করেছিল।সন্ন্যাস নিলেই যে সন্ন্যাসী হতে হবে এমন
তো কোনো মাথার দিব্যি নেই কোথাও।খুদি ঠাকুমার
কথা তো এবাড়ির সকলেই জানে।তার যে নাগর, দিব্য
সন্ন্যাস এক, কোথা থেকে এসে, বাড়ির ঠাকুরঘরে থেকে গেল
আজীবন।পুজোর আয়োজনের ভার নিয়ে খুদি ঠাকুমা
প্রায় সারাদিনই সে ঘরে কাটাতেন।
বিপিনবিহারী অরণ্যে চলে গেল।জঙ্গলে নয়। জঙ্গলে কেমন
একটা জঙ্গলা জঙ্গলা ভাব থাকে।বনে যেমন থাকে
বুনো বুনো গন্ধ।অরণ্য বললেই এক আল্ট্রা আধুনিক
যুবতীর মুখ ভেসে ওঠে।
সে রাধা এখন বিধবা হয়েছে।শরীর খাটিয়ে তার পেট চলে
কোনোমতে।বিপিনের কথা ভাবতে ভাবতে একদিন সে
হবে অস্তমিত।
#
৫৬)
অস্তমিত
অস্তমিত হবার আগেই সূর্য আর একবার দেখে নেয়
বাড়িটাকে।এটাই তো তার শেষ অস্তমিত হওয়া নয়।
কাল সকালেই আবার আসতে হবে পূর্বদিকে। ডেকে
তুলতে হবে বাড়ির সবাইকে।তারপর সারাদিনের কাজ।
এভাবে আসা যাওয়া করতে করতেই তো কেটে গেল
কয়েক লক্ষ বছর।সময়টা ঠিক কত, অঙ্কের শিক্ষকরা
বলতে পারবেন।তখনকার দিনে তো বার্থ সার্টিফিকেট
বলে কিছু ছিল না।সেসব নেই তার এবং ওই বাড়িরও।
এবাড়ির খুঁটিনাটি সবকিছুই সে জানে।নিজের চোখেই
দেখা।যদি কখনও কোনো ঝামেলা কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়
তাকে তো সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠতেই হবে।কোনো মিথ্যেকে
গোল্ডমেডেল পেতে দেবে না সে।
আজ বিদায় নেবার সময়ও দেখে গেছে ,একটা হাল্কা
নীল রঙের সবুজ শাড়ি, বারান্দাকে বলছিল তার পুরনো গল্প।
#
৫৭)
গল্প
গল্প গল্পের সব কথা বলে না।কেটে ছেঁটে বাদ দেয় কিছু।
কিছু সে সংযোজন করে যা কখনোই ছিল না গল্পে। যেমন
এপরিবারের কর্তা আর গিন্নি স্বপ্ন নিয়ে একমত ছিলেন না
কখনও। কর্তা মনে করতেন স্বপ্নকে তৈরি করতে হয়
পাথর কেটে,শুকনো কাঠ থেকে, মাটি পুড়িয়ে পুড়িয়ে।আর
গিন্নি মনে করতেন স্বপ্ন ফুলের মতো ফুটে বিছিয়ে থাকে
স্বপ্নের মধ্যে।সে স্বভাব জাত।সে প্রকৃতি।তাকে সংগ্রহ
করতে হয় যত্ন করে।
একটা শব্দের মোহে একটা কবিতার বই লেখা হয়ে যায়।
কবি চলে যাবার পর সেই শব্দটিকে বিভিন্ন লোকে বিভিন্নভাবে
দেখে।কেউ দেখে ছুটন্ত ঘোড়া তো কেউ দেখে মূক অভিমানী
ফুটপাত। এবাড়িতে একজন কবি ছিলেন।কেউ তাকে দেখেনি
কখনও।বেঁচে থাকতে তার নামও শোনেনি।কিন্তু মৃত্যুর পর
যখন সেই কবি বেঁচে উঠলেন ,তখন সকলে চিনতে পারল -
ইনিই তাদের লেনিন।
এখন তো কীবোর্ড ছাড়া কিছু লেখা যায় না।একটা আবেদন
জানানো হয়েছে ডেক্সটপের কাছে।আশা করা যায় সে অবশ্যই
আয়োজন করবে এক কবিসভা।
#
৫৮)
কবিসভা
কবিসভায় কবিতার সভা বসে না।নিছক একটা বাড়ির নাম।
কেন এমন নাম? যদি এবাড়িটার নাম হতো সোনাঝুরি ,
তাহলেও কি এ প্রশ্ন উঠত না, কেন সোনাঝুরি? প্রশ্নকে
আপ্যায়ন করার মতো কেউ নেই এবাড়িতে।
বাগান-বাড়ির পিছন দিকে একটা ঘর পরিত্যক্ত আছে
বহুকাল।সেদিকটাকে কোনো দিকের নাম দিয়ে চিহ্নিত
করা যাবে না। দিকচিহ্নহীন।ঘর একটা আছে নিশ্চিত।
কিন্তু সেটাও প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। নিজেকে প্রমাণ করার
কোনো তাগিদ নেই তার।ঘরের ভেতরে একজন বয়নশিল্পী
আছে।কেউ তাকে জন্মাতে দেখেনি।বংশলতিকায় তার নাম
নেই।কেউ তাকে মরতেও দেখেনি।লোকটা কখনও এক, কখনও
বহু।তার কাজ কেবল বয়ন।
জলের উপরতল ঢেকে আছে হেলেঞ্চালতায় আর কচুরি
পানায়। কচুরিপানার ফুল ফুটলে বুঝা যায় ঈশ্বর থাক আর
না থাক, সন্দেহের উর্দ্ধে সৌন্দর্যের বিভা।
#
৫৯)
বিভা
বিভা একটি বাঙালি মেয়ের নাম হতে পারে।এই নামে
গ্রামে ও শহরে অনেক মেয়েই থাকতে পারে।এমন কি
এবাড়িতেই এই নামে একাধিক মেয়ে আছে।কিন্তু তাদের
কারো সম্পর্কেই কিছু বলা লোকটির উদ্দেশ্য নয়।আর
বিভাবসু নামের যুবকটিকেও যে লোকে সংক্ষেপে বিভা
বানিয়েছে, লক্ষ করেও কিছু বলেনি।
বিভা দিয়ে বাক্যরচনা করতে গিয়ে যে ছেলেটি লিখেছিল -
ফুটন্ত গোলাপের সৌন্দর্যের বিভায় মুগ্ধ হয়েছি, সে এখন
কলেজে বাংলার অধ্যাপক।বিভাগীয় প্রধান।
বিকালে বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে সূর্যালোকের
যে বিভা এবাড়িতে প্রবেশ করে, তা মাখতে মাখতে প্রতিদিন
এক শামুক বাড়ির সবচেয়ে বড় আর সাজানো ঘরটিতে ঢোকে।
তারপর সে কীকরে, খবরে আসেনি কখনও।অর্থাৎ বিভা
সে যেই হোক, যেমনই হোক, সারা পৃথিবীর মতো এবাড়িও
খুব উদাসীন।
#
৬০)
উদাসীন
উদাসীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়িটি একা ।কী চিন্তা
সে করে? তার চোখ দেখলেই সে ছবি আঁকা খানিকটা
সহজ হয়।আর একজন বাড়ির সঙ্গে তার খুব সখ্য ছিল
একসময়।শাহ আবদুল করিম সেখানে আকাশ আঁকতেন,
নদী আঁকতেন নিজের কণ্ঠে।
এখন আকাশের গায়ে অনেক চর্মরোগ।এখন জলের স্রোতে
জমে গেছে অনেক কোলেস্টেরল।লালনের মতো একজন
ডাক্তার পেলে, সুস্থতাকে বন্ধুর মতো পাওয়া যেত।অথচ
এই তো সেদিন আমাদের কালিকা প্রসাদ চলে গেলেন।
মাসকাবারি চাল শেষ হয়ে গেছে।শেষ মাসটিও হয়তো
খরচ হয়ে গেছে।জোড়বিহীন শালিকটিকে কেউ দেখতে
চায় না, সে জানে।
তবু এখনও এবাড়িতে বেজে চলে কে এল সায়গলের
বুকের কণ্ঠ।যদি কারো কানের তৃষ্ণায় একটু প্রেমের
মাখন লাগানো থাকে,স্পষ্ট দেখতে পাবে,পঙ্কজ কুমার মল্লিকের
সূর্য বিছানো আশমান।
#
৬১)
আশমান
আশমান-রঙের আকাশের মধ্যে আসন পেতে বসে আছেন
তিনি।বাড়িতে যখন তিনি ছিলেন, সকলের মতো তিনিও
ডাল-ভাত খেতেন।রেডিওর সঙ্গে গল্প করতেন।গালার রেকর্ডের
বুকে যে রবীন্দ্র-কণ্ঠ লুকানো আছে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সারা শরীরে
মাখতেন।সকলের মতো তাঁরও স্পর্শের ইচ্ছা ছিল হাতে।সেইসব
ইচ্ছা, স্পর্শ না পেয়ে পেয়ে, জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল।তখন
লোকে তাকে ভয় পেত।শরবতের মধ্যে বেশি করে কেওড়া মিশিয়ে
পান করতে চাইতেন।তবু কেউ বিশ্বাস করত না তাঁকে ।
পুরনোদিনের নির্বাকচিত্রের মতো তিনি বার বার কেটে যেতেন
সুস্থ চোখগুলোর ভিউ পয়েন্টে।
বাড়ির দেওয়ালে এখনও তাঁর একটা পোট্রেট আঁকা আছে।
একটা আয়নার সাহায্য নিয়ে সেই ছবিতে তিনি নিজেই
দেখতেন নিজেকে।
প্রযুক্তি-পুষ্ট পৃথিবীতে তাঁর কোনো ইতিহাস নেই।গালার
রেকর্ড বা সিডিতেও তিনি নেই।ঢুকতে পারেননি ইউটিউবে ।
#
৬২)
ইউটিউব
ইউটিউব বাজিয়ে বাজিয়ে শোনে কোনো কোনো ঘর।
সেখানে কোথাও তুমি নেই।আমিতেই পরিপূর্ণ তার সব
দেওয়াল।পুরনো-তৃষ্ণার খোঁজে এখনও অনেক অতিথি
এখানে আসে।দেওয়ালে দেওয়ালে হাত রাখে।যেন তারা
টেরাকোটা নারীদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিজের ভাষায় আনতে চায়।
এখনও প্রাচীন কিছু পাখি অকারণ খেয়াল বশে আশাবরী
শোনে।কান পেতে শুনতে চায় অতীতে যা অকথিত ছিল।
প্রেমের গল্পের মাঝে প্রেমিক ও প্রেমিকার উচ্চারণ ও
আচরণ ছাড়াও প্রেমের নিজস্ব কিছু কথা থাকে, যৌনতায়
চাপা পড়ে যায়, যুগে যুগে।
এবাড়ির উঠোনে একটা ঝাউগাছ আছে। রাত্রের অন্ধকারে,
শীতে ও বর্ষায়, সে একা একা, নিজের কবিতা নিজে পড়ে।
পাড়ার লোকেরা তার নাম প্রয়োজন হলে উন্মাদ বলে।
#
৬৩)
উন্মাদ
উন্মাদের জীবনেও একবার প্রেম জুটেছিল।প্রেমিকা জোটেনি।
একতলায়, গ্যারেজ-ঘরের পাশে ,ঘরের মতো দেখতে, একটা
গরীব ঘর ছিল জানালাবিহীন।দরজার পাল্লাহীন ঘরে ,তার
নৈশপ্রহরী ছিল রাত।সর্বোচ্চতলার এক পিংক কালারের ঘরে
পান্নারঙের এক রুবি ছিল।এক গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ
সেই রুবির জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। এবং উন্মাদ পরিচয়ে সে
যাবতীয় রাজকীয় আহার ও বিহারের সুখকে হারিয়ে দেয়।
মাধবীলতা প্রায় সব মানুষকেই একটু করে উষ্ণতা দেয়।কিন্তু
উন্মাদটির জন্য তার পক্ষপাতিত্ব একটু বেশিই ছিল।
বছরে বছরে অনেক পাতা গাছ থেকে ঝরে পড়েছিল
বাগানের মাটিতে।আর অনেক পাখির পালক।সেখানে
সূর্য আসত, গাছের ডালপালা সরিয়ে, উন্মাদের কাছে
ভালোবাসা শিখতে।
তার মৃত্যুর পর রুবির হৃদয়ে অনেক নুন জমে উঠল।
চুপিচুপি সে সেই নুন নিয়ে গিয়ে রেখে আসে উন্মাদের সমাধিক্ষেত্রে।
#
৬৪)
সমাধিক্ষেত্র
সমাধিক্ষেত্র থেকে উঠে বসেছেন সিরাজ।বাড়িতে আবার
যাকিছু ঘটছে, তাতে উমিচাঁদের গন্ধ পাচ্ছেন যেন।পাচ্ছেন
জগৎশেঠের অশরীরী গ্রাসের আভাস।
অন্যদিকে জব চার্নকও স্বস্তিতে ঘুমাতে পারছেন না। স্পষ্ট
টের পাচ্ছেন, আবার কারা যেন তাঁর মারিয়ার দিকে হাত
বাড়াচ্ছে।মেয়েরা সহ তাঁর সুতানুটির কুঠিবাড়িও যেন
কারা দখল নিতে চাইছে।
মীরজাফরের এগারোশো বংশধরও হওয়ার গতিবিধি ঠিক
বুঝতে পারছে না।
এখন যারা এবাড়িতে আছে তারা কেউ দেখতে পায় না।
দেখতে না পাওয়ার জন্য কোনো কষ্টও নেই। দেখতে
পাওয়া যে চোখের কাজ, যেন তারা জানে না।
বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতার বৃদ্ধি, নতুন নতুন ভাইরাসের উদ্ভব,
ভিনগ্রহ থেকে আসা দুর্বোধ্য মহাজাগতিক সংকেত, আর
বাড়িতে প্রতিদিন একাধিক খুন ও ধর্ষণ- এইসব নিয়ে
একটা বুলেটিন, রোজ ছাপা হয়।
#
৬৫)
ছাপা হয়
ছাপা হয় বর্ষার প্রতিটি দিন জল রঙে। তেল রঙে আঁকা হয়
প্রতিটি শীতের দুপুর।সেইসব ছবি ভেসে আছে সময়-তরঙ্গে।
অনেক গানের কণ্ঠ ছিল।নাচের নূপুর ছিল।মহড়া নাটক নিয়ে
ব্যস্ত থাকত প্রতিটি সন্ধ্যায়।গল্প ভরা গর্ভাশয় নিয়ে মেয়েরা
অন্দর থেকে জাগিয়ে রাখত বাইরের অন্তরমহল।একটি বড়
বকুল গাছের তলায় সকাল এসে নাম ধরে ধরে ডাকত সক্কলেকে।
সদর দরজার দুপাশে দুটো ঝাউগাছ।এক মিলিমিটার করে
বেড়ে উঠছে প্রতিদিন।ঝাউগাছ বলতেই কেউ যেন নির্জনতা বা
দগ্ধ বাতাসের হতাশা না বোঝেন।দুপাশ থেকে দুটি অপরাজিতার
লতা ওদের প্রেমের ছোঁয়া নেয়।এসব নিয়ে একদিন আরও কিছু
ঝকঝকে বাংলা কবিতা লেখা হবে।ছাপা হবে মাউসের ক্লিকে
নয়ানজুলির বড় বড় পানিফল ।
নীরবতার মধ্যে প্রতিদিন ছাপা হয় চালতাগাছের পাতা আর
চাপটগরের থোকা থোকা সাদা রঙের গান।এর প্রতিটি বর্ণ,
অক্ষর নিবিষ্ট মনে লিখে রাখছে দুদিকের দুটি ঝাউগাছ।
#
৬৬)
ঝাউগাছ
ঝাউগাছ দুটো এখন বেশ বড় হয়েছে।পিছনে মূল বাড়ির
অনেকটা অংশই ভেঙে পড়েছে।ভাঙছে প্রতিদিন।তবু এখনও
কিছু মানুষ সেখানে বাস করে।সঙ্গে আরশোলা, মাকড়সা,
টিকটিকি নিয়ে।এখনও উঠোনে বেড়াল দেখা যায়।রাস্তার
কুকুরগুলো ভাঙা পাঁচিল দিয়ে ঢুকে পড়ে।বৃষ্টিতে বা বৈশাখের
খরতা থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেয়।
ভাঙা, স্যাঁতা, রঙচটা, শ্যাওলাপড়া কয়েকটি ঘরে এখনও
যারা বসবাস করে, ভালোবাসায় প্রগাঢ়ভাবে বিশ্বাস করে,
এখনও তারা নামকরণ ও জন্মদিনের অনুষ্ঠান করে।
এবাড়িতেই, মোবাইল টাওয়ার খুব দুর্বল হলেও কয়েকজন
ছেলেমেয়ের অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে। চ্যাট করে হোয়াটসঅ্যাপ,
ম্যাসেঞ্জারে।চ্যাট করতে করতে চট করে একদিন তাদের
দেখাও হয়ে যায় মালাবদলের ঘড়িতে।
লাউ, কুমড়ো, পুঁইযের মাচাগুলো বাদ দিলে, বাড়ির বাকি অংশ
জঙ্গলে ঢেকে গেছে।সেখানে ছায়ায় কেবল ঠাণ্ডা নয়, পাওয়া যায়
অসাধারণ কিছু ছবি।
#
৬৭)
ছবি
ছবিরা ব্যস্ত থাকে নিজেকে তুলতে, আঁকতে, রাঙাতে ও ভাঙতে।
ফটোগ্রাফাররা তাদের ক্যামেরার খুব যত্ন করে।অনেক রকমের লেন্স
রাখে।জুম বাড়ায় ,কমায়।আলো-ফ্ল্যাশের ব্যবস্থা রাখে প্রয়োজনে।
চিত্রকরেরা রেখা, রঙ ও হরতন নিয়ে ক্যানভাসকে কথা বলায়।
বাড়িতে তারা সকলেই ছিল।এক এক দল এক একটা মহলায়
থাকত।ছবির সম্পূর্ণ ছবিটা খুব বড়।সেটা কোনো নির্দিষ্ট, দেমাকি
মহলায় আটকে রাখার জিনিষ নয়।কোনো ঘরে ঢোকানো যায় না।
টাঙানো যায় না দেওয়ালে।সে থাকত সম্পূর্ণ বাড়িটা জুড়ে।
টপ্পা, ঠুংরি, তারানা - এরা সকলে সরোদ, সেতার, সন্তুরদের সঙ্গে
ছবি নিয়ে আলাপ করে।পণ্ডিতরা নির্ণয় করেন ছবির এখানটা ভুল
ওখানটা বেশ নতুন, সেখানটা মারহাব্বা।ছবি সবসময়ই তার
নিজের ভাষায় কথা বলে।
বাড়িটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার আগে একদিন আমরা সবাই হিন্দু-মুসলিম,
বাঙালি-পাঞ্জাবি, সাদা-কালো,বেঁটে-লম্বা,অধ্যাপক ও টিপসই চুটিয়ে
পিকনিক করব। পিকনিক চলাকালীন সময়ে ছবিরা একমনে
নিজেরা নিজেদের করবে সংগ্রহ।
#
৬৮)
সংগ্রহ
সংগ্রহ করার নেশায় একটা লোক এখানে আসে।একাএকা,
চুপিচুপি, চোরের মতো।পুরনো রেকর্ডপ্লেয়ারের স্মৃতি,
পকেটের ঘড়ি,ক্যাসেটের ভেতরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পানের
ডাবু, ভাঙা জাঁতি, হ্যারিকেনের সলতে, সমুদ্রগুপ্তের টাকা।
যেসব রাস্তারা এখানে আসত, সেগুলো এখন কাঁকর, কাঁটা
আর ভাঙা কাচের টুকরোয় ভরা।বিক্ষত হবার ভয়ে হয়তো
কেউ আর আসে না।বাতিল সংগ্রহকারী লোকটা কেবল আসে।
একটা বড় অর্জুন গাছ আছে এখানে।সে তার শত্রু-সম বন্ধু।
অপেক্ষায় থাকে।নিজের স্মৃতির ভাগ দিতে চায়।
এখানে অনেকবার মহামারি, অতিমারি হয়েছে।অনেকবার
বন্যা ও ভূমিকম্প।যুদ্ধ, দাঙ্গা হতো নিয়মিত, রীতিমত আয়োজন করে।
যুদ্ধ করতে করতে যারা মারা গেছে, অক্ষত রেখে গেছে বাড়িটাকে।
অনেক মানুষ তাই এখনও সকাল বিকাল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গেয়ে
চিকিৎসা করে অন্যদের।
রোজ,নতুন করে,অনেক মেয়েরা হচ্ছেন গর্ভবতী। আর একবার
বেঁচে উঠছে সেই গত শতাব্দীর তালগাছটি,পুড়ে গিয়েছিল বজ্রাঘাতে।
#
৬৯)
বজ্রাঘাত
বজ্রাঘাত মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।এখনও কয়েকটা
পাখি এখানে ফিরে আসে সন্ধ্যায়। মেহফিল বসে কবিতার।
তুলসী, বাসকের গাছগুলো এখনও রয়েছে হাতের কাছেই।জল
এখনও তৃষ্ণার্তকেই ভালোবাসে।
আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে শহরে।দরজার সামনে অতিথি
নামিয়েছে বাস।ভেঙে পড়া অংশের মেরামতির জন্য রাজমিস্ত্রী
নেমেছে কাজে।শাঁখের মুখে জল দিয়ে হাতের তালুতে ঘুম ভাঙাচ্ছে
বাড়ির মেয়েরা।তাদের শাড়ির গন্ধে মুছে যাচ্ছে সব বজ্রাঘাত।
ঘরে ঘরে যাদের ছবি ঝুলছিল দেওয়ালে, তারাই যেন মনে হচ্ছে
সেকেন্ড ইনিংসের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে।বাড়ির খুব ভেতর থেকে
বাতাসে ভেসে আসছেন বিলায়েত হুসেন খাঁ।বর্ষার কাছে উপহার পাওয়া
জমিতে আনন্দ রোপণ করছেন চাষীরা।আলোর চেয়েও দ্রুত
ছুটে আসছে যুদ্ধ জয়ের সমাচার।
#
৭০)
সমাচার
সমাচার ছড়িয়ে রেখেছে গুলঞ্চ।এই সমাচারের বিশেষণ যে
সু, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।যে বালিকার আঁচলে সংগ্রহ
করার কথা ছিল, সে ডাক দিয়েছে সকলকে।সবার আগে
সাড়া দিল পাখিরা।
রাত্রির কালো হবার প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে গেছে।এবার এই
গুলঞ্চরাশি জনে জনে বন্টন করতে হবে।কেউ আর ঘুমিয়ে থাকবে না।কেউ আর পর্দা খাটানোর আয়োজনে
ব্যস্ত থাকবে না।
প্রতিটি ঘরের দরজা খুলে গেছে। জানালা খুলে গেছে জোয়ারে।
রাজ্যের রাস্তা আর আকাশ আর সাইবেরিয়ার মাঠ ঢুকে পড়ছে
বাড়ির ভেতরে।ঘরগুলো একটা অসীম কাচের পাত্রের মধ্যে
শরবত হয়ে মিশে যাচ্ছে।
বাড়ির সব লোকেরা খাবার টেবিলে বসেছে একসঙ্গে।সংখ্যায়
তারা যে কত, ঠিক করতে পারছে না।প্রতিঘন্টায় দরকার
নতুন জনগণনা।
#
৭১)
জনগণনা
জনগণনার কথা শোনা যাচ্ছিল বহুদিন।বাড়ির সকলে
তৈরি হচ্ছিল নিজে নিজে।টিকটিকি, আরশোলা, ইঁদুর,
গিরগিটিরাও মনে মনে নিজেদের গুনে রাখছিল।যদিও
গাছপালাদের রাজত্বে এ নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না।মাটিতে
তাদের শিকড় বহুদূর পর্যন্ত ঢুকে আছে।ততদূর পৌঁছাতে
পারবে না শুমারির ছাঁকনি।
একটা লোক বহুদূর থেকে একটু একটু করে বড় হচ্ছিল
দূরবীনের মধ্যে।যখন একেবারে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল,
দেখা গেল তার হাতে এক দিস্তা সাদা কাগজ। জামার
পকেটে গুঁজে রাখা আছে কয়েকটি পেন।সে সময় এখানে
প্রতিবেশিদের ঘরে রান্নায় ফোড়ন দেওয়ার ক্ষণ।তার গন্ধ
লোকটির নাকে এলেও সে নিজেকে বহুধা করার দিকে গেল না।
এমনকি দ্বিধাও করল না একবারও ।
বাড়ির লোকেরা সবাই নিজ নিজ কাগজপত্র নিয়ে হাজির
হলো।শুমারির লোক তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, গলা তুলে
ডাক দিল - একবার বাইরে আসবেন মুখার্জিবাবু , দরকার
কেবল আপনার সঙ্গেই।
- Get link
- X
- Other Apps