পাপের গুনাহ দেখি না
দহন
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কোটি কেলভিনের আয়োজন করেছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম
ইউনিভার্সের মহল্লা জুড়ে ।
আগুন স্বয়ং সেখানে স্বাহাকে সঙ্গে নিয়ে
কীভাবে পুড়তে হয় তাই শিখতে গেছে ।
আমার সেখানে আমন্ত্রণ না থাকলেও
তুমি নিজেই সেখানে গেছ
যজ্ঞকুণ্ডগুলোকে দাহ্য করে তোলার দায়িত্ব নিয়ে ।
দশ বিশটা গ্যালাক্সি যেন তুমি
এক এক বেলায় ঘুরে নিচ্ছ পায়ে পায়ে হেঁটে ,
কেলভিন সংসারের সেই তাপকে বরাভয় দিচ্ছ
শান্তিজল দিয়ে ।
এদিকে এই পৃথিবীতে এক ভাঙা মাটির ঘরে
জ্বরের আগুনে পুড়ছি আমি ।
আমাদেরও
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আজ এখানে বিক্ষিপ্তভাবে হাল্কামাঝারি প্রাকবর্ষার বৃষ্টি হয়েছে ;
পাথর ,মাটি ,জল - সকলেই টিপটিপ টিপিরটিপ মেখে
ঘামাচির জ্বালা মিটিয়েছে ।
এতদিন তোমাদের পাড়ায় সে ছিল তুমুল ; সঙ্গত কারণেই
কিছুটা দেমাক তোমার বেড়েছিল ।
আমরা সে দেমাকের প্রত্যেকটি কয়েন জমা রেখেছি , আর
ধীরে ধীরে সেগুলোকে মুগ্ধতায় পরিণত করে চলেছি সকলে ।
আজ আমাদের পাড়ায় বিক্ষিপ্তভাবে হাল্কামাঝারি , এবং আগামীকাল
ভারী থেকে অতিভারী প্রেমের ইশারা মিলেছে ।
কয়েক হাজার বিশেষণের অধিকারী তার-স্পর্শ থেকে
যেসব ফুল ,ফল , খারিফশস্য আমাদের ক্যানভাসে আসবে
তোমাদের পাড়ায় পাড়ায় পাঠিয়ে দেব পুরো আধাআধি।
কালকের হাসি
দিশারী মুখোপাধ্যায়
বহুদিন পর আজ হাসিটি এসেছে । এই সময়টির দৈর্ঘ্য বুঝাতে
আমি এক-এর গায়ে একটি বহুপ্রসবিনী-শূন্য বসাতে পারি , কিন্তু
কোনো প্রাণীর গ্রীবার ব্যবহারে রাজি নই ।
কন্ঠটির সঙ্গে দেখা হয় রোজই । কথা হয় । দ্রব্যমূল্যের কথা ,
রাজনীতির কথা ।নীতির স্খলন নিয়ে কথা বলে রোজ ।
রাগ থাকে , ঘৃণা থাকে , অভিমান থাকে । পর্যাপ্ত পরিমাণে
ঈর্ষাও থাকে সেই কণ্ঠে ।
বহুদিন পরে আজ হাসিটি এসেছে । হাসি থেকে রঙ জন্ম নেয় ।
সেই রঙ লিখতে বসে জীবনকাহিনি । যে জীবনে কাহিনি নেই
সে জীবনও গ্যালাক্সির মতো ধনী হয়ে ওঠে ।
দুর্বোধ্য প্রেম
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আমি যেসব কথা তোমাকে লিখে পাঠাই , তুমি তার
কোনো অর্থ খুঁজে পাও না ।বিশ্বাস করবে কিনা জানি না,আমিও যখন আকাশ গঙ্গায় স্নান সেরে প্রক্সিমা সেন্টাউরির দিকে বিস্তারিত ভূবনটিকে বুঝতে চাই , কোনো অর্থ খুঁজে পাই না।অথচ কী বিশাল সেই গণিতবিহীন গণিতের ছড়িয়ে পড়া উজ্জ্বলতা ও আঁধার মেশানো বিনয় ।
আমি কথাগুলো সরলবাক্য ,যৌগিকবাক্য ,জটিলবাক্য এমনকি সমাপিকা ও অসমাপিকা বাক্যেও পরিবেশন করি ।লেখাকালীন সময়ে আমি রান্নাঘরে যাই ,কলঘরে যাই , টিভি চালাই ,ঝাউগাছের সঙ্গেও কথা বলে আসি । এরা প্রত্যেকেই আমাকে একটু একটু করে সাহায্য করে ,পরামর্শ দেয় ,কোন কথা কেমন করে বললে তোমার পছন্দ হবে ।অথচ তোমার তা হয় না !
ফিরিয়ে যে নেব তাদের , তাও পারি না ।তুমি না বুঝলেও তারা তোমাকে দিনে দিনে অনেকটাই বুঝে নিয়েছে , তোমার নরম গোলাপের মতো কলজেটিকে ।
কয়েকটি ফেসবুক পোস্টের প্রতিক্রিয়া
দিশারী মুখোপাধ্যায়
মানুষকে এখন ভালো অথবা খারাপ করে তোলা
সামান্য পরিমাণ আয়াস এবং সময়ে,খুব সহজ হয়ে গেছে ।
একজন বললে - টগরফুলগুলো যেন আগের মতো আর অতটা সাদা নেই । সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে প্রায় সব লোক টগরকে মলিন বলল , কালো বলল । অনেকে বলল - টগরের মতো খারাপ ফুল আর হয় না । কেউ কেউ বলল - টগর নিতান্তই এক আবর্জনা ।
অন্য আর একদিন একজন বলল - আমাদের শহরের নর্দমাগুলো আগের মতো আর দুর্গন্ধময় নয় । কয়েক মিনিটের মধ্যেই টু-কে লাইক পড়ল , ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ-কে কমেন্টস পড়ল । সেসব কমেন্টস প্রায় সবই রজনীগন্ধা ,গন্ধরাজ , কামিনী কিংবা জুঁই ফুলের গন্ধে ভরা ।
কেউ একজন যদি নর্দমা বিষয়ে প্রকৃত সাংবাদিকতা করে তো,তাকে সকলেই অশ্লীল শব্দের ডিক্সেনারি উপহার দেয়।পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীও তাকে তাদের সক্রিয়তা বুঝিয়ে দিতে উদ্যোগী হয় ।
একেই কি মেষ-সংবহন বলে ?
সাফল্য
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ফিরে আসতে চাইছি তোমার কাছে , পারছি না ;
চতুর্দিকের সব রাস্তাতেই আজ তাপপ্রবাহের লাল সতর্কতা।
প্রথম চেষ্টা আমার ব্যর্থ হলো ,
দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হলো ,তৃতীয়বারেরও ।
এরকম অসংখ্য ব্যর্থতা সংগ্রহ হয়েছে আমার ,
সেগুলোকে আমার লাফ দেবার ক্ষমতা অনুযায়ী
নির্দিষ্ট দূরত্ব বরাবর পাতছি এবার ।
এত যে ব্যর্থতা আমি সংগ্রহ করেছি , এও বুঝি কোনো পারা নয় ?
সমস্ত না-পারা দিয়ে
ভিন্ন এক রাস্তা যদি তৈরি করি ,পারব নাকি ফিরে আসতে?
পারব , পারবই , পারতেই হবে ।
তোমার বাগানের গাছে
ঠিক ঠিক সময়ে তুমি জল দিও শুধু ।
আঁধিরও মৃত্যু আছে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
তোমাদের আয়োজিত অন্ধকারকে আমি ভয় পাই ,
তোমাদের কৃত্রিম আলোতেও আমি সাহস পাই না ,
আমি তাই নিজস্ব অবোধ অন্ধকারে আত্মগোপন করেছি ।
সমস্ত পৃথিবীজুড়ে ধুলোঝড়ের দাপট চলছে ,
আমার চোখ ,নাক ,কান কেউ সেখানে কাজ করতে পারে না ,
স্বখাত-সুড়ঙ্গে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছি তাই ।
স্বপ্ন দেখার পুরনো পদ্ধতিগুলো আর কাজ দিচ্ছে না ।
পুকুর নেই , পানা নেই , পানিফল নেই । মিথেন রয়েছে কেবল ।
তবে মিথেনকে আমি বলব না কিছুতেই আলহামদুলিল্লাহ ,
কারণ আঁধিরও মৃত্যু আছে ।
গড় জীবন
দিশারী মুখোপাধ্যায়
খুব বড়ো বড়ো কিছু বাড়ির মুখোমুখি হবার সুযোগ পেয়েছি কয়েকবার। তবু সেসব বাড়ি কেন বড়ো , কতটা বড়ো তা জানা বোঝা হয়নি । সে বাড়িতে মোট কতগুলো ঘর , কোন ঘরে কতগুলো দরজা জানালা , কী তাদের গথিক বা ফ্যাশান তা জানার পথে যাওয়া হয়নি ।কোন ঘরে কে থাকে , কতদিন ধরে থাকে , আগে কে কে ছিল , পরে কে কে থাকবে , সেসব জানার বাসনা জাগার সুযোগ হয়নি ।সেসব বড়ো বড়ো বাড়ির বাইরে যেসব ছোটো ছোটো গাছপালা থাকে ,অলিগলি থাকে ,কল্পনা থাকে ,গল্পগাছা থাকে ,তারা আমাকে তাদের মধ্যেই আটকে রাখে ।অথচ বড়োর ভেতর যেমন ঢোকা হয়নি , ছোটোদের ভেতরেও ঢোকা হয়নি বিন্দুমাত্র । যাকিছু ছোটো ,যাকিছু বিন্দুর মতো , ছোটোত্বের ক্ষমতায় তারাও যে মোটেই ছোটো নয় ।
বড়ো দেখা হলো না ,ছোটো দেখা হলো না ,অংশকে দেখা হলো না , দেখা হলো না সমগ্রকেও। আর তা হলো না বলেই নিজেকেও দেখা হলো না , জানা হলো না ।এইরকম যাবতীয় অজানার গৌরবহীন গৌরব নিয়ে জীবনকালকে খরচ করে চলেছি সম্ভাবনাহীন আরও কিছু অস্বপ্নের মতো স্বপ্নের দিকে ।
কিছু কথা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
দিনও নয় রাতও নয় তখন ,
আলো অন্ধকার সমানভাগে মেশানো
একটা দ্রবণের মধ্যে
এই চরাচর ডুবে ছিল ,
ছিল তোমার ডুরে শাড়িটিও ;
তখন কিছু কথা এসেছিল ।
মাঝদুপুরেও কিছু কথা এলো
বহুদূর থেকে রোদে পুড়ে হাঁটতে হাঁটতে ।
সেসব কথাগুলো এমন একটা মন খুঁজছিল
যেখানে অল্প জলের মধ্যেও
শালুকের মতো ফুটে থাকা যায় ।
রাত বারোটার দুএক মিনিট আগেও
কিছু কথা এসেছিল
তার ছিঁড়ে যাওয়া লাইন অতিক্রম করে আসা
সবশেষ লোকাল ট্রেনের ক্লান্ত বিধ্বস্ত বগিতে ।
ইদানিংকার দুষ্প্রাপ্য স্বপ্নের মধ্যে সেই কথাগুলো
জোড়কলম গাছের মতো আশ্রয় পেয়েছে ।
যাবার ইচ্ছা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কোথা দিয়ে যাব , কোথায় যাব , কিছুই জানি না ।
আমার এই না-জানাকে আমি বহুকাল ধরে চিনি ,
সেই যখন একটি বালক
খোলামকুচি দিয়ে পুকুরের জলে বৃত্ত এঁকেছিল ,
ফ্রকের রঙ আর তার উপর ছাপা লতাপাতা দেখতে দেখতে
যখন সেই বালকটি হারিয়ে গেল একদিন ।
এখন পৃথিবীর সব বিস্ময় পুরনো হয়ে গেছে ,
পৃথিবীর সব গাছ আর তাদের জীবনকাহিনী নিতান্তই মামুলি হয়ে গেছে ।
কেবল কোথাও যেন যাবার একটা ইচ্ছে রয়ে গেছে এক প্রবীণের বুকে ,
কোথায় যাবে সে জানে না ,
উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকুও আর নেই ;
অথচ যেতে তাকে হবেই ।
অস্তিত্ব বিপন্ন হলে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
যখন যেখানে যেটুকু কুড়িয়ে পেয়েছি
তাকে আরও ভাঁজ করে ,আরও ছোটো করে
লুকিয়ে রেখেছি আরও গোপনতাহীন গোপনতায়।
সেখানে লোকে আসে যায় ,পায়ে পায়ে ধুলো উড়ায়,
থুতু ফেলে , চকোলেট আর কন্ডোমের প্যাকেট ফেলে যায় ।
একদিন কেউ আমাকে সাহসী হতে শিখিয়েছিল ,
রাস্তা আঁকার ক্লাসে কোথায় কোন রঙ কেমনভাবে ব্যবহার করলে
হারিয়ে যাওয়া ক্রিয়াপদটিকে এঁকে ফেলা যায়
শিখিয়েছিল কেউ ,
আজ আমি তাদের ভুলে গেছি ভুলে যাবার চেষ্টা না করেই ।
এখন আমি শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এক জীবন ,
নিরাশ্রয় , ভবঘুরে ।
ফিরে আসতে চাইছি অথচ একটা ফাঁকা শরীর পাচ্ছি না কোথাও ,
আমার পুরনো শরীরও অন্য লোকের দখলে ।
তোমার বই
দিশারী মুখোপাধ্যায়
জানি তোমার বইটির চূড়ান্ত পর্যায়ের আকার ও পরিচিতি পাওয়া
শেষ হয়ে গেছে বহুদিন আগেই ,
সে বইয়ের আর পুনর্মুদ্রণ সম্ভব নয় কিছুতেই ।
সে বই এখন এত পুরনো হয়ে গেছে
কেউ আর হাত দেয় না , গন্ধ শোঁকার ইচ্ছে জাগে না ,
পাতা উল্টাতেও ভয় পায় লোকে ,পাছে ভেঙে যায় ।
অনেক অনেক লাইন অস্পষ্ট হয়ে গেছে , মুছেও গেছে ।
সেইসব না-ভরাট না-ফাঁকা জায়গাগুলো
বিবর্ণতা বাজায় এক ভায়োলিনের বুকে ।
যদি কোনোদিন এক হতচ্ছাড়া চোর সে বাড়িতে ঢোকে ,
যদি প্রাচীন আমলের অলংকার ,গত শতাব্দীর কাঁচা টাকা
কিংবা এ শতাব্দীর যাবতীয় পাসওয়ার্ড হাতের কাছে পেয়েও
আকৃষ্ট না হয়;
যদি সে তোমার পুরনো বইটিকে দেখে , যদি হাত বাড়ায় ছুঁতে চেয়ে ,পড়তে চেয়ে ;
যদি সে মুছে যাওয়া লাইনগুলো
নতুন করে লিখে দিতে চায় , তার আকার এবং পরিচয়কে স্পর্শ না করেই ; --
জানি তোমার বুকের ভেতরটা দুরদুর করে কেঁপে উঠবে,
জানি তোমার বুকসেলফের কাচ ভেঙে যাবে ।
ভয় পেও না , এসব কিছুই হবে না ।
এখন আর কেউ বই পড়ে না , আমিও পড়ি না ।
বেরিয়ে এসো
দিশারী মুখোপাধ্যায়
একইসঙ্গে কিছুটা ঘুম এল ,
আর তোমার জন্য কিছুটা ইচ্ছে ।
রাত একসময় ফুরিয়ে গেল ,
দিন একসময় ফুরিয়ে গেল ,
জীবনও একসময় ।
সারারাত জুড়ে ঘুম এল না ,
স্বপ্ন এল না ,
ফুটল না ফুল ।
সমস্ত দুনিয়া ঢেকে গেল কেবল ঘুমের চাদরে ।
একদিন ভোর চারটের এক গাড়িতে
পৃথিবী থেকে বিদায় নিল অতিমারি ,
সকাল সকাল বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেল খবরের কাগজ ,
তাতে বড়ো বড়ো অক্ষরে ছাপা ছিল তোমার হাসি।
এখন একইসঙ্গে কিছুটা বাঁশি এল ,
আর তোমার জন্য এল কিছুটা যমুনা।
তুমি কেবল তোমার থেকে বেরিয়ে এসে তথাস্তু হয়ে ওঠো ।
প্রিয় অপরাধ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
অপরাধ আমার মধ্যে আশ্রয় চাইছে কিছুদিনের জন্য ।
আমার নিজের ফুলবাগান আছে ,
যে কোনো রাস্তার পাঁচমাথায়
আমার বাড়ি যাওয়ার জন্য বাস পাওয়া যায় ,
চা খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন রঙ ও আকৃতির
অনেক কাপ কেনা আছে আমার ঘরে ,
বন্ধুরা আড্ডা মারতে এলে প্রয়োজন হবে বলে
চব্বিশঘণ্টা সময় ভরে রেখেছি ঘড়িতে ,
এছাড়াও আমার নিজের লেখা কয়েকটি
বিশুদ্ধ কবিতার বই আছে ।
অপরাধকে আশ্রয় দেওয়া কি আমাকে মানায় ?
তবু তাকে আশ্রয় দিয়েছি ।
আমার মস্তিষ্কের বুকে যে প্রেম আছে
সেই প্রেম তাকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতে চায়নি,
এতে যদি থার্ড ডিগ্রি আমার প্রাপ্য হয় আমি রাজি ।
বাস্তবতা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
যদি আজ তোমার দৈনন্দিনের থোড়-বড়ি-খাড়াতে পাঁচবার ভুল হয়
আমার এখানে অক্সিজেনের মাত্রা কিছুটা বেড়ে যাবে ।
এ ঘটনা যে কীভাবে সত্য হয় , কেন সত্য হয় , বাজারের গণিতে
তার উত্তর মেলে না ।
পদার্থকণার অতিপ্রিয় কোয়ান্টাম থিওরির মতো যাদুকরও
অবাক বিস্ময়ে দেখে
তোমার সেসব ভুল থেকে জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয় , আর
তুমি তাতে দীপ্ত হয়ে ওঠো বারবার ।
তবে এসব কিছুই হবার নয় বলে হয় না ।
আজও তুমি সমস্ত কাজ যথাযথ সম্পন্ন করো ,
আজও সঠিক সময়ে সঠিক গাড়ি ধরে সঠিক বাড়িতে ফিরে আসো ,
আজও নিমগাছের জন্মদিন জানার ইচ্ছা জাগে না ,
যেভাবে জানতে পারবে তোমার একাউন্টে জমা পড়েছে এমাসেরও মাইনে ,
তেমনই জানতে পারবে না
আমার হেনাগাছের পাতায়
সূর্যের আলো পৌঁছালো কিনা৷
জীবনের অতিস্থূল বিষয়গুলো কোনোদিনই
প্রেমের রসায়ন বা উপকরণ হিসাবে বিবেচিত হয়নি ।
তুমি নও ,পর্দা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
একবার মনে হলো তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ ,
মনে হলো চায়ের কাপ হাতে
কিংবা হাত ভরা উষ্ণতা
কিংবা অতিরিক্ত লোভের মাথায় মনে হলো
উষ্ণতা ভরা সমর্থন এনেছ সঙ্গে ।
এরকম মনে হওয়া
জীবনে যে কতবার ঘটেছে আমার , কহতব্য নয় ।
চারপাশ দেখে নিয়ে যদি চুপিচুপি বলি ,
এমনকি এই চুল্লিমুখী বয়সেও , বারবার
প্রতিটি মিনিট যেন ষাটেরও অধিক সেকেন্ডকে ধারণ করতে চায়
সেই মনে-হওয়াটুকু উপভোগ করবে বলে ।
চশমার কাচ ধোয়া-মোছা হয়না আজকাল ,
চোখকে দৃষ্টির আর ততটা ভরসা নেই বলে ।
একবার যে মনে হলো তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ ,
কেন মনে হলো ?
ওটা একটা পর্দা , মেরুন রঙের , ঝুলে আছে দরজার পাশে ।
মাঝেমধ্যে নড়াচড়া করে ,
তোমাকে নিয়ে গল্প লিখলে ,যেভাবে লিখতাম দুএক লাইনে , সেভাবে ।
ওটা তো পর্দা , তুমি নও ।
তোমাকে চিনি না
দিশারী মুখোপাধ্যায়
তুমিই একমাত্র জানো তোমাকে আমি সঠিক চিনি না ,
তেমন চিনি না ,
মোটেই চিনি না ।
তোমাকে চিনি না বলে ,চেনা কীরকম ,
কীভাবে তা নির্ধারিত হয় , কিছুই জানি না বলে
ভাষণে আসনে ডাক পাইনি কোনোখানে ।
অথচ কী বিচিত্রভাবে এ সংসারে তুমি কীরকম বেখাপ্পা !
যে-আমি চিনি না তোমাকে ,সেই আমাকে চিনতে চেয়ে তুমি পাগল !
তোমার উপরে কত লেখা হলো ,
তোমার উপরে কত বলা হলো ,
তোমার উপরে উঠে ,উঠতে উঠতে ,তোমার চেয়েও কত বড়ো হয়ে যায় তারা
জানতে পারোনি তুমি ।
অথবা জেনেও মুখ বন্ধ করে থাকো ।
তুমি একমাত্র জানো
তোমার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না ।
তোমাকে জানি না আমি
যেভাবে জানি না এই ভাঙা পাথরের একটিও খাঁজের রহস্যকে ।
বৃষ্টি হবে আর একদিন
দিশারী মুখোপাধ্যায়
শোনা যাচ্ছে নাকি পৃথিবীতে আর একবার খুব বৃষ্টি হবে।
দশবছর আগে আমাদের পাড়ায় যেভাবে যেখান দিয়ে এসেছিলে ,
এখন তুমি আসতে চাইলে সেসব আর পাবে না ।
তবু বলছি , যদি খুব অনিচ্ছা না হয় , আর একবার এসো ।
যদি না আসো , বলা যায় না , হয়তো পৃথিবীতে আর কোনোদিনই
গানের ইস্কুলগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
আমি না চাইলেও , বয়স আমাকে চেয়েছে ,গুণে মুগ্ধ হয়ে ।
কাজেই অনাহুত হয়েও যখন সে এল ,ফেরাতে পারিনি ,
থাকতে দিয়েছি আমার সঙ্গেই ,হাড়েগোড়ে, চোখে-কানে ,মেধায়-মননে ।
আমার ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যাবেই , কেউ নেবে না ।
এটা যখন পরিষ্কার করে বুঝতে পারলাম আর মেনে নিলাম ,
তখন একটা তিনহাত পরিমাণ লাঠিকেই সেটুকু দিলাম ;
ভালোবাসারই পরামর্শে সেই লাঠিটার নাম দিলাম ঈশ্বর।
ডাকলেই সে সাড়া দেয় , যেকোনো কাজ দিলে, - যেটা সে করতে পারবে,
তৎক্ষণাৎ করে দেয় । থাকে সঙ্গে সঙ্গে ।
আমার এক নাস্তিক বন্ধুর ঈশ্বর শব্দে আপত্তি আছে বলে
লোক সমক্ষে তাকে সে নামে ডাকতে পারি না , গোলাম বলে ডাকি ;
তাতে অবশ্য সে কিছু মনে করে না ।
আমার সেই নাস্তিক বন্ধুটি ওষুধ খায় ,চশমা পরে ,নিজে গাড়ি চালিয়ে
আসা যাওয়া করে আর মাঝেমধ্যে ছাতাও ব্যবহার করে।
যাক সে কথা । বলছিলাম যে - শোনা যাচ্ছে নাকি পৃথিবীতে
আর একবার খুব বৃষ্টি হবে ।পারলে সেদিন একটু ভিজে নিও ।
আমার পৃথিবী
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আমার পৃথিবীর দুটো মেরু এখন একই জায়গায় খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে ,
কাজেই আমার পৃথিবীটা বেঁকে ইংরেজি অক্ষরের ইউ-এর আকার নিয়েছে ।
জঙ্গলে শাল মহুয়া যেমন ছিল তেমনই আছে ,
ছোটো বড়ো নদীগুলো অসুস্থ শরীর নিয়েও টিকে আছে অনেকেই ,
উঁচু নিচু পাহাড় পর্বতগুলোও তাদের বেড়ে যাওয়া বয়স নিয়েও দাঁড়িয়ে আছে এবং তারা
যে যেখানে ছিল ,মোটামুটি একরকমই আছে ।
এসবের পাশে
কতটুকুই আর জীবন থাকে একটা মানুষের হাতে ।
মেরুদুটোরও বয়স ,রক্তচাপ ,রক্তে শর্করার মাত্রা
কমবেশি পরিবর্তিত হতে হতে
আমার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই একজায়গায় দাঁড়িয়েছে ।
পৃথিবী নিয়ে আজ এত কথা বলার একটা কারণ আছে ,
সে কথা গোপন রেখেও বলছি
আজ আমি পৃথিবীর বাইরে , অনেক দূরে অবস্থান করছি
একটুকরো পাথরের মতো , শূন্যের আশ্রয়ে ।
সময়-নামচা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
নিরুৎসাহ জনিত কারণে বহুদিন চুপচাপ থাকার পর
হাওয়া কাল রাতে একটু শরীরচর্চায় মন দিয়েছিল ।
কখনো পূর্ব থেকে পশ্চিম , কখনো পশ্চিম থেকে পূর্বে
মৃদু দ্রুততায় যাওয়া আসা করছিল । সেকারণে আমাদের পাড়ায়
৪০ থেকে ৫০ গতির এক ঝড় উঠেছিল ।
কিছু শুকনো গাছের ডাল ভেঙেছে বাড়ির উঠোনে ,
ছাদ বাগানের টবের গাছ উল্টে পড়েছে , আর
আমাদের সংসারের ঝিমিয়ে পড়া কয়েকটি সম্পর্ক সামান্য নাড়া খেয়েছে ।
সকালে উঠে সেইসব ভেঙে পড়া শুকনো ডাল সরিয়েছি ,
টবগুলোকে সোজা করে উঠে দাঁড়াবার জন্য উৎসাহ দিয়েছি ,
নাড়া খাওয়া সম্পর্কগুলোর সঙ্গে কথা বলে জল মেপেছি ।
এইসব করতে করতে হাঁটুর ব্যথা ,পেটের সমস্যা আর
গতরাতের ভুলে যাওয়া স্বপ্নটার জন্য যেমন একটু আধটু সময় দিতে হয় দিয়েছি ।
এরকম নিত্যকর্মগুলো করতে গিয়ে মায়াময় চব্বিশঘণ্টা শেষ হয়ে
ঘড়ি একেবারে ফাঁকা হয়ে যায় ।
আগামীকালের জন্য ক্যালেন্ডারের তারিখ পাল্টানোর সময় দেখতে পেলাম
আজ তোমার জন্মদিন ছিল ।
ইলিউশন কিংবা কিছু
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কেউ কি আসছে ? হয়তো কেউ আসছে ।
কার পায়ের শব্দের গোলাপ-পাপড়িতে
বাতাস যেন রহস্যময় হয়ে উঠছে ।
কে কাকে ডেকেছিল , কে কার কাছে আসতে চেয়েছিল,
- এইসব নিয়ে একদা প্রত্যেকদিন
একটা করে ছোটোগল্প লেখা হতো ।
সে গল্প কে লিখত , কে পড়ত ,
কার গায়ে জেগে উঠত পদ্মকাঁটা , - ইতিহাস লেখকরা
সেসব লেখেননি কিছুই ।
কেউ কি আসছে ?
শোনার জন্য কানখাড়া একজন আহাম্মকের ।
কেউ তো আসছে না ,
বরং কেউ যেন চলে যাচ্ছে ।
বাতাসের গায়ে তাই খুব জ্বর ,
ব্রহ্মাণ্ড ডুবিয়ে দেওয়া জলও শুষ্কতায় কাঠ ।
জামা পরানো কথা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কথাগুলো সরাসরি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ুক কেউ চায় না ,
অনেকেই তাদের ভালো ভালো পোশাক পরায়,
কেউ কেউ বর্ম দিয়ে ঢেকে দেয় নরম শরীর।
তুমি যদি কথাগুলোকে একটা একটা করে হাতে নিয়ে পরখ করে দেখো ,তবে দেখবে
তাদের প্রত্যেকের গায়ে অন্তত একটা করে আস্তরণ আছে।
জল কিংবা তেল দিয়ে ঘষাঘষি করলে যা উঠে যায়।
অড়হর গাছের শুঁটি ছাড়িয়ে দানাগুলো খেলে
স্বাদ পাওয়া যায়,সেই স্বাদ পেতে চাইলে
কথাগুলোর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করো।
যদি একবার অন্তরঙ্গ হতে পারো তবে দেখবে
তারা তাদের সমস্ত গোপন কথা,অকৃত্রিম কথা, তোমাকে শোনাবে।
অথচ হাজার রকমের ও রঙের পোশাক পরতে পরতে
আমাদের স্বভাব এমনই হয়ে গেছে
আমাদের বলা ,শোনা , দেখা কাউকেই আমরা
ফাঁকা মাঠে খালি গায়ে খেলতে দিতে চাই না ।
শত হস্ত দূরে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
যেখানে হাট বসে , আমাদের যাওয়া আসার রাস্তাগুলো
তার চারদিক দিয়েই ছড়িয়ে আছে। হাট শব্দটির ব্যবহার নিয়ে
শব্দ সচেতনদের ভুরু ঈষৎ কুঞ্চিত হতেই পারে , কিন্তু
এ জায়গাটিতে সত্যই হাট বসে , আক্ষরিক অর্থেই হাট।
অর্থাৎ এশব্দটি আমি কোনো গূঢ় অর্থে ব্যবহার করিনি।
ওই রাস্তাগুলো যখন আমাকে একজন পথিক হিসেবে পায়
আমি কোনোভাবেই ওই হাটের দিকে তাকাই না। যারা হাট থেকে
এসে এ রাস্তায় পড়ে , কিংবা যারা এ রাস্তা থেকে হাটের দিকে যায়
তাদের মুখে হাট সম্পর্কে অনেক কিছু শুনি । যেহেতু হার্ট সম্পর্কে
তোমাকে কিছু বলা আমার উদ্দেশ্য নয় , তাই রাস্তাগুলোর সঙ্গে
আমার সময়-কাটানোর সময় আমি মহাকাব্যের অবাস্তবতা নিয়ে
কোনো বিচার বিশ্লেষণে যাই না ।
যখন যেখানে তুমি নিজেকে খরচ করছ, তখন সেখানে যাবার
সব পথ খোলা থাকলেও সেসব পথ আমাকে পায় না, পাবেও না।
অব্যক্ত আকন্দ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
সামান্য একটা গন্ধরাজের গাছ লাগিয়েছি ।
আগের মতো গন্ধরাজগুলো আর অসামান্য হয় না,
আগের মতো গন্ধরাজগুলো আর তত বড়ো হয় না,
আগের মতো ওই গাছে আর অনেক ফুলও ফোটে না,
ওদের গন্ধও আর আগের মতো রেওয়াজ করে না ।
আসলে এইমুহূর্তে আমি গন্ধরাজের কথা বলতে চাইনি,
বলতে চেয়েছিলাম আকন্দের কথা।
গতকালের কনসার্টে গানের সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হয়েছিল
সেগুলো পূর্বনির্ধারিত ছিল না,
অনুষ্ঠান কক্ষের বাইরে সেই কথাগুলো মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েছিল।
আমি কখনো কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিনা সেটি
কখনো কেউ চা-পানের বিরতিতেও রাখেনি ।
একটা শব্দ হচ্ছে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
মাঝে মাঝেই বাইরে একটা শব্দ হচ্ছে।
যে তরঙ্গ মাত্রায় সে নিজেকে বিছিয়ে দিচ্ছে, তার তীব্রতা
আমাদের শ্রুতিগ্রাহ্য ; অথচ সমান আবেদনগ্রাহ্য নয়
সকলের কাছে।
গ্রাহ্য শব্দটির অর্থের কথা চিন্তা করতে গিয়ে
অকস্মাৎ তোমার কথা মনে পড়ে যায়,
তোমার কথা মনে পড়লেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুমপ্রবণ একটা লোক কী পরিমান শব্দকে অগ্রাহ্য করতে পারে
সকলেই জানে , অন্তত শব্দ স্বয়ং জানে ভালোমতো।
বাইরে একটা শব্দ হচ্ছে মাঝে মাঝেই ,
কিন্তু আমি যে তার চেয়েও অনেক অনেক বাইরে পড়ে আছি ;
সে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না।
সমস্ত শব্দ একদিন থেমে যাবে নাকি সে
তার শ্রুতিগ্রাহ্যতা হারাবে ,
তা নিয়ে আপাতত গবেষণা চলুক।
ভঙ্গুর ঘুম
দিশারী মুখোপাধ্যায়
প্রতি ঘন্টায় একবার করে ঘুম ভেঙে যায় ,
স্পষ্ট বুঝতে পারি
সেটুকু ঘুমের মধ্যে যতটুকু স্বপ্ন ছিল
তারমধ্যে স্বপ্নের পরিমাণ খুব কম ছিল ।
চোখ মেলে দেখি
টবের নয়নতারায় , রাস্তা যেখানে পথ হয়ে উঠতে পারেনি,
সর্বত্রই অন্ধকার ছয়লাপ ।
দরজার পাশে কেউ যেন কখনো একবার এসেছিল ,
তারপর যা হয় , সে দরজাই নিজে নিজের চারদিকে
ঘুরে ফিরে খুঁজতে থাকে , পায় না কাউকেই ।
পাওয়া আর না-পাওয়াদের ব্যক্তিগত সমস্যা দিয়ে
বালাপোষ বানাতে চাইনি কখনও ,শুধু চেয়েছি
স্বপ্নের সবটুকু যেন ভরা থাকে স্বপ্ন দিয়েই।
ভেঙে যাওয়া ঘুমের মধ্যে যদি একটু জেগে ওঠা থাকে ,
তোমাকে পাঠাবো ।
ঘুম এবং তুমি
দিশারী মুখোপাধ্যায়
পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটা ঘুমের ছাতা
মাথার উপর এসে দাঁড়িয়েছে ,
সে আমাকে এখন জেগে থাকতে বারণ করছে ।
পৃথিবীর সব ক্রিয়া পদগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে চাইছে ,
অপ্রয়োজনীয় করে দিতে চাইছে আলোকে ।
জল ঢেলে ঢেলে আমি ঘুমের ঘনত্ব কম রাখছি ।
সেই ছাতার কাপড়ে কম করে হলেও দু একটি ছিদ্র রয়েছে ,
আঙুল ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে আমি সেগুলোকে বেশ বড় করে নিলাম।
এক কথায় ঘুমের প্রেমকে আমি প্রত্যাখ্যান করলাম ।
এ সময়ে আমার মনের মধ্যে উপুর্যপুরি বেশ কয়েকটি বাংলা বাক্য এলো ,
বাক্য গুলো সবই তুমি বিষয়ক ।
সেসব কথাগুলোকে তৎক্ষণাৎ না লিখে রাখলে হারিয়ে যেতে পারে ।
সংসারের আর সব কাজের ক্ষেত্রে আমি যেমন দায়িত্বজ্ঞানহীন
এ বিষয়ে তেমনটা নই মোটেই ।
ঘুমের ছাতাটা ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন সরে গেল ,
কাজেই এখন অন্য কোন কাজ নিয়ে না বসে
ঘুমের জন্য একটু চেষ্টা করা উচিত ; আমি সেটা বুঝি ।
মাধবীলতা আজও সুন্দর
দিশারী মুখোপাধ্যায়
উনিশশো সত্তরে তার জন্ম ,
উনিশশো ছিয়াশিতে সেই প্রথম দেখে মাধবীলতা।তার আগে ,
কৈশোরে, "কয়েকটি গাছের নাম বল" - প্রশ্নে
অনেকগুলো গাছের সঙ্গে এই নামটিও বলেছিল ।
সাহস করে একদিন কাছে গিয়ে সে দেখলো
সেই গাছে অনেক ফুল । তাদের রূপ আর গন্ধ , দুজনেই
সুন্দর মন্তব্যটির দাবিদার ।
সেই মন্তব্যটি করতে গিয়ে , যা সে চেয়েছিল বলতে ,
কেঁপে উঠেছিল বুক দুরুদুরু ; ঠোঁটের ভেতর হয়েছিল ভূমিকম্প ।
এখন দুহাজার চল্লিশ ,
ছানি কাটিয়েছে বেশ কয়েক বছর হল ,
গত মাসেও আরো কয়েকটা দাঁত নিজে নিজেই ছুটি নিয়েছে ,
হাঁটুকাঁপা এখন খুবই সাধারণ একটা বিষয় ।
মাধবীলতা এখন সঙ্গেসঙ্গেই থাকে ,
উঠতে বসতে তাকে সাহায্য করে প্রতিফলে।
মাধবীলতা আজও সুন্দর ।
আশার বয়স বাড়ে না
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আশার অনেক বয়স হয়েছে ।তবু সে এ কথা মানতে চায় না ।
একটা বাড়ি তৈরীর কাজ হচ্ছে অদূরে ।
ইট ভাঙছে , পাথর কাটছে ,লোহার হাতুড়ি কথা বলছে
লোহার রডের সঙ্গে ।এতে নানান রকম শব্দ তৈরি হচ্ছে।
তৈরি হওয়ার শব্দগুলো প্রথম সারি , দ্বিতীয় সারি , দশম সারি -
এভাবে কয়েকশো সারিতে বৃত্তের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পিছু পিছু ।
তারা নিশ্চয়ই কোথাও যেতে চাইছে,হয়তো যাবে, যাবেই।
কাছেই একটা পিচপাথরের রাস্তা আছে। প্রচন্ড বৈশাখের দাপটে
নির্জীব সেটা পড়েছিল চিত হয়ে ।
একটি মেয়ে তাকেই এইমাত্র ছুঁয়ে দিয়ে , 'আয়' বলে ডাক দিয়ে গেছে ।
স্বভাবতই সে এখন সজীব, ছুটছে ,এসকালেটর ।
কত রকমের গাছ আছে এইসব ঘটনার চারদিকে। তারা সকলেই
ফুল ফুটাতে জানে , ফল ফলাতে ।
আশার জন্যই এসব ঘটনা নিত্যবৃত্তবর্তমান ।
পাপের গুনাহ দেখি না
দিশারী মুখোপাধ্যায়
পাপের দুর্নিবার আকর্ষণে মুগ্ধ হই ।বারবার আমি তাকে
আমার প্রিয় ক্যাডবেরি চকলেট কিংবা ভ্যানিলা আইসক্রিম খাওয়াই ।
ওহে দূর ভূখণ্ডবাসীনি ,
কি নাম তোমার আমি জানিনা , তবে পাপের প্রসঙ্গ উঠলে
সংখ্যাগরিষ্ঠ পূতরা তোমার সম্পর্কে বলতে চেয়ে (পাপ
নিয়ে নিন্দাবান্দা করার জন্য)পাঁচখানি মুখ ব্যবহার করে।
তুমি নাকি পাপের এন্টিভাইরাস । তুমিই নাকি পুণ্য ।
প্রায়শই এরকম হয় , সেমিনারের বিষয় কি ছিল তা আলোচকদের
ভুলিয়ে দিই আমি । আজ কিন্তু সেরকম হবেনা ।
একটা মস্ত বড়ো কেক আমি কিনে এনেছি পাপের জন্য,
বছরে ৩৬৫ দিন তার জন্মদিন পালনে একটু একটু করে কাটবো বলে ।
পাপের রূপে গুণে আমি ফিদা ।তার কোনো গুনাহ দেখি না ।
ঈর্ষা ও আমি
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ঈর্ষা ও আমি এক ঘরে বসবাস করছি এখন। এক থালায় খাই ,
এক বিছানায় শুই ,পরস্পরে দয়িত ও দয়িতার অভিনয় করি ।
একে অপরকে ভালোবাসি ,ঘৃণা করি। দংশন ও চুম্বন করি ।
ঈর্ষাকে খুঁজলে আমাকে পাবে , আমাকে খুঁজলে তাকে।
বড়ো বড়ো বাড়ি , বড়ো বড়ো প্রান্তর , বড়ো বড়ো পৃথিবী
পছন্দ করি না আমরা দুজনেই ।সে জানে আমিই সবচেয়ে বড়ো ,
আমিই সবচেয়ে মহান , আমিই সবচেয়ে উঁচু ।আমিও এরকম
জানি একমাত্র তাকেই ।
কোথা থেকে , কিভাবে সে এসেছিল আমার কাছে, প্রিয়তম হলো ,
আমাকে অভিন্ন করে নিল তার সঙ্গে ।আমিও জানিনা।
ঈর্ষার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না ডারউইন। জানতে চাননি।
হয়তো সংক্রমনের ভয়ে ।
পূর্বাভাস
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আজ বৃষ্টির কথা বলা হয়নি ,
তবে আঞ্চলিকভাবে মেঘের কারণে কোথাও কখনো
দুএক পশলা হতেও পারে , বলেছিল ।
আজ বাতাসের তাপমাত্রা আটত্রিশ ডিগ্রি , অথচ
তা অনুভূত হচ্ছে ছেচল্লিশ ।দু'লক্ষ কিউশেকের একটুকরো দামোদর
যেন ফুটছে আর তার দুপারে অনেক মাংস রান্না হচ্ছে তার ভাপে ।
গানের ভাষা শুকিয়ে মারা যাচ্ছে । সকালের মাছগুলো
মরে কাঠ হয়ে গেছে জেলের খালুইয়ের মধ্যে ।সরিয়ে রাখা
জালের গায়ে সূর্যের আলোয় আঁশগুলো চকচক করছে।
যদিও পূর্বাভাস নেই , তবুও কি বৃষ্টি হবে না একটুও ?
হয়তো হবে। কে যে কোথায় সে আশায় বসে আছে জানি না ,
কিন্তু বিশ্বাস করি কেউ না কেউ আছেই ।এও যেন খানিকটা পূর্বাভাস।
সময়কে দেখেছি
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আমি নিজেই তো দেখেছিলাম , তাই আমি নিশ্চিত।
গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি ,পরনের লুঙ্গি , লেখার চেয়ারে বসে,
একটা পা খাটের উপর তুলে ,অন্য পা-টা সেই খাটের তলায় মেঝের উপর রেখে
থুতনিতে হাত দিয়ে , কোনো একটা চিন্তাকে অবলম্বন করে ,বসেছিলাম।
ঘরে আর কেউ ছিলনা , বাড়ি ফাঁকা ছিল ,
এবং আমি যখন তা দেখেছিলাম সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকে
ফাঁকা মনে হচ্ছিল ।
এখানে অবশ্যই বলা প্রয়োজন - আমার টেবিলটা তখন
অনেকটা দূরে , ছিটকে , একা একা , বিমূঢ় ।
আমি নিজে চোখেই এসব দেখেছি বহুবার ,
আজ এই মুহূর্তেও দেখতে পাচ্ছি ।স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
সেই একই মুদ্রায় বসে আছে সময়।
একটা পাঞ্জাবি
দিশারী মুখোপাধ্যায়
চেয়ারের উপর বসে আছে একটা লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি ,
মাথার উপর ফ্যান ,চোখের সামনে ঘড়ি আর
জানালার বাইরে কয়েকটি গাছের ডাল নড়ছে । ঘরের মেঝের উপর
নড়ছে ওই পাঞ্জাবির ছায়াও ।
সামনে টেবিলে ,ল্যাপটপের মধ্যে লগ-ইন করা জি-মেইল ,
খাটের বিছানা ,পাশাপাশি অন্য ঘরগুলো , ঘরের করিডোর
আর বাড়ির উঠোনে
প্রচুর ঘুম পড়ে আছে ,যেন ঝরে পড়তে না-পারা বর্ষার মেঘ ।
মাঝে মাঝে চোখের পাতা বন্ধ করে পাঞ্জাবিটা ,
তখনই ওই ঘুমগুলো পায়ে পায়ে ওর দিকে এগোতে থাকে।
কিছু শব্দ ,যা এককালে হয়েছিল বা হবে আগামী ভবিষ্যতে ,
ওকে নাড়িয়ে দেয় তখনই ।চোখের পাতা খুলে যায় ওর।
একটি সাদা কাগজ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
একটা সাদা কাগজের উপর লিখে ফেললাম কয়েকটা লাইন।
ব্যাকরণ সম্মতভাবে সেগুলোর কিছুটা শুদ্ধ কিছুটা অশুদ্ধ ,
সেগুলোর কোনোটা সমাপিকা কোনোটা অসমাপিকা,
কোনোটা সংলাপ কোনোটা প্রলাপ ।
এইসব কথাগুলো যখন লিখছিলাম
আর একটি সাদা কাগজ তখন চুপ করে অপেক্ষায় ছিল,
সে হয়তো তখন মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল
কোন কোন কথা সে কেমনভাবে বলবে ।
পরবর্তী সাদা কাগজটি হাতে নিয়েছি আমি , তখন
আর একটি কাগজ এগিয়ে আসে অপেক্ষার লাইনে ।
একদিন অন্য একটি কাগজ হয়তো এগিয়ে আসবে এখানে ,
বসবে আমার সামনের ফাঁকা চেয়ারে , আর বলবে -
আমি আমার সব কথাই লিখে এনেছি ,
তুমি কেবল পড়ে নাও আমাকে।
অসনাক্ত স্বপ্ন
দিশারী মুখোপাধ্যায়
গত রাতের স্বপ্নটা কোন বিষয়ের উপর ছিল
মনে করতে পারছি না ,
এটুকু মনে করতে পারছি সেটা সম্পূর্ণ শেষ হয়নি
এবং সেখানে ধারে কাছে কোথাও তুমি ছিলে না।
সকালে কলে জল এল , পেপারওয়ালা এল
এবং ডিডি বাংলা চ্যানেলে ঘোষণা মত নির্দিষ্ট শিল্পীটি
গান গাইতেও এল ।
স্বপ্নটা মনে করতে না পারার জন্য সকালের চা পানে
আমার আগ্রহ এল না , যেসব ব্যায়ামগুলো
আমি আমার শরীরকে প্রতিদিন শেখাই , শেখানো হল না ,
দীর্ঘ তৃষ্ণার পর বৃষ্টি এলেও
স্নানে গাছগুলোর তেমন আগ্রহ দেখা গেল না ।
আবার যদি সেই অসমাপ্ত স্বপ্নটা আসে , তবে
আজ সকালে যে-গাছ থেকে তুমি ফুল তুলতে এসেছিলে, সেটাকে
সেই স্বপ্নের মাটিতে পুঁতে দেব।
অনুক্ত কথা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
যেসব কথা একজন মানুষের মধ্যে জীবনভর জন্ম নেয়,
প্রকাশিত হবার সুযোগ পায় না , তারা
ভূস্তরের নিচে চাপা পড়ে থাকে ।
যদি কখনো কোনো উৎখননের ফলে
শিলার শরীর থেকে তারা উঠে আসে ,
সে লিপির পাঠোদ্ধারের লোক পাওয়া যায় না ।
সেইসব মৃত কথার অতৃপ্ত আত্মাগুলো
ঘুমের অভাব নিয়ে ঘুমাতে যায় বাধ্য হয়ে ,
তারপর অনন্তকাল
মুখ বুজে সহ্য করে সময়ের হিংস্র উৎপীড়ন ।
ভালোবাসাও কোনোদিন সেই সব কথার ভাষা বোঝেনি,
সে কেবল দ্রুতগামী যান আর উড়ানের প্রযুক্তি চেয়েছে।
যা আপনার কাজে লাগে না
দিশারী মুখোপাধ্যায়
অনেক রকম কাজের চাপে থাকেন আপনি।বুঝি।দেখতে পাই।
পাতি মধ্যবিত্ত মানুষের মতো এক আধখানা বাড়ি আপনার নয় ,
শীতকালীন ,গ্রীষ্মকালীন ,দেশে-বিদেশে , নগরের আলিশান ,
গ্রামের বাগানবাড়ি , এরকম বহু ।
তাদের দখলে রাখা ,শরীর স্বাস্থ্যের খবর রাখা ,
তালা ও পাসওয়ার্ডের জন্য একটা নোটবুক চর্চা,এইসব নানান কাজ।
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে আমার বয়স যখন পঁয়ত্রিশ ছিল ,
টানা পাঁচ সাত ঘন্টা হাঁটতে পারতাম।
সেসময়ই হাঁটতে হাঁটতে অগস্থের সঙ্গে ,হিউয়েন সাঙের সঙ্গে ,
এমনকি একজন নিয়ান্ডারথালের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল।
তাঁদের ততটা কাজের চাপ না থাকায়
দুএক দণ্ড কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গে।
আপনার বাড়ির বাইরে একটা বড়ো ডাস্টবিন আছে ,
অনেক লোকের অনেক কথা সেখানে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ,
পড়ে আছে আমারও অনেক দুঃসাহসিক বলতে চাওয়া।
আপনার কাজে লাগবে না বুঝেই
কাজের লোকেরা সেসব বাইরে ফেলে দিয়েছে।
একজন চোর নাকি সেই সব কথা ,প্রতিদিন কিছু কিছু, চুপি চুপি
নিয়ে যাচ্ছে তার জাদুঘরে ।
অন্তঃসারশূন্য সময়
দিশারী মুখোপাধ্যায়
পঁয়ষট্টি বছর বয়সে আমি প্রথম পাকা বাড়ির ছাদ ঢালাই দেখলাম ।সারা জীবনে বড় বড় প্রাসাদ অট্টালিকা যে কম দেখেছি তেমন নয় ,কিন্তু কিভাবে কেউ একজন গড়ে উঠছে - তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
পুকুরের জল দেখলে লোকে যেমন ঢিল ছোঁড়ে কিংবা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে চিৎকার করে প্রতিধ্বনি শোনে , সেভাবেই কেউ কেউ আমাকে গড়ে উঠবার জন্য প্ররোচিত করতে চাইতো।আমি সেসব প্ররোচনায় পা দিইনি।
কিছুদিন আগেও ইউটিউবের এক ভিডিওয় প্রাচীন কালের ছাদ পিটানোর গান শুনেছি । আজ প্রথম দেখলাম কিভাবে একটি শূন্যস্থান নির্ভরযোগ্য কঠিন ছাদ হয়ে উঠছে দেখতে দেখতে।
পঁয়ষট্টি বছর আগে জন্মেছিলাম ।পঁয়ষট্টি বছর পরে চোখ ফুটল।অর্থাৎ চোখ ছাড়াই কেটে গেল একটা জীবন।
পবিত্র পাপ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
পৃথিবীতে অপরাধ করার মানুষ একেবারেই কমে গেছে,
অপরাধ শব্দটির অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বসেছে তাই।
অতিরিক্ত ধর্মচর্চার জন্য এই সংকট তৈরি হয়েছে, কিন্তু
নিজেকে নিষ্পাপ রাখার মতো আমার তেমন কোনো সেনিটাইজার নেই ।
বিপদে পড়লে খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চায় সকলেই ,
এই শব্দটিও তাই আমাকে নগণ্য ভেবে তাচ্ছিল্য করেনি,
সে তার অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য ছুটে আসছে আমার দিকে ;
আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি ।
এই ঘটনার অল্প দিনের মধ্যেই
আমার ঘরে জমা হয়েছে অনেক পাপ ।
তার কেউ ভাগীদার নেই , চোর নেই ,
শব বাহকের মতো তার প্রেমিক নেই ।
ছিরিছাঁদহীন এক টুকরো পাথর ,নির্বান্ধব একটি ঘর,
অন্ধ একটি রাস্তা ; - এদের প্রত্যেকেরই খুব কষ্ট ।
কাঁদছে এরা প্রত্যেকেই ,কাঁদছে আমার জন্য ,আমার কষ্টের কথা ভেবে ।
তারা হয়তো জানে না , এই পাপই আমার এক পবিত্র সত্তা।
একটি মাত্র শাড়ি
দিশারী মুখোপাধ্যায়
একটি বহুতল বাড়ির ছাদের কথা বলতে চাইছি ,
সেই ছাদের আয়তন পনেরো হাজার বর্গফুট এবং
একটি মাত্র শাড়ি সেই ছাদের উপর টানাপোড়েন নিয়ে ঝুলে থাকে ।
অদূরে একটি বড়ো রাজপথ আছে। সেই রাজপথে
একটি যুবক রোজ চিরকালীন যৌবনসহ দাঁড়িয়ে থাকে
অসীম ধ্রুবত্ব নিয়ে , সেই ছাদের দিকে তাকিয়ে ।
তাকে দেখতে দেখতে কাছাকাছি থাকা একটি কৃষ্ণচূড়ার
কোমর টনটন করে ওঠে একসময় ।
বহুতল বাড়িটিতে কয়েকশো ঘর আছে । তারই কোন একটি ঘরে
এক মৎস্যকন্যা , ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতে থাকতে বিবর্তনবশত
যার পুচ্ছটি শ্রীরাধার চরণযুগলে পরিবর্তিত হয়েছে ,
ছাদে উঠে সে-ই ওই শাড়ি মেলে দেয় ।
সেই একটি মাত্র শাড়িতে
পনেরো হাজার বর্গফুটের ছাদ ঢাকা পড়ে যায়।
আমার বয়স
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আমার চারপাশে অনেক মানুষ আছে। তাদের সকলেরই
বৃদ্ধি খুব স্বাভাবিক গতিতে । কয়েকজনের বৃদ্ধির মাত্রা
অতি দ্রুততর।
আমার চারপাশের লোকেদের যদি চোখ থাকতো
তবে তারা দেখতে পেত - একটি শামুক পাথর নয় তবু পাথরের মতো অনড় ।
তারা যে তা দেখতে এবং জানতে পারেনি আর অবশ্য
কোনো প্রমাণও নেই ।
আমার জন্মের কুড়ি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর
আমার জন্ম হওয়ার শুরু হয় । নড়তে শুরু করি । তাও
গতি অতি মন্থর ।
যাদের বয়স এক বছরে এক বছর বাড়ে অথবা বছরে পাঁচ,
তাদের বহু আগে আমার জন্ম হওয়া সত্বেও
আমি তাদের চেয়ে অনেকটা ছোটো ।
সঙ্গত কারণেই আমার ছেলের চেয়েও আমার বয়স
অনেকটাই কম। নাতি নাতনিরাও বেড়ে উঠছে চড়চড় ।
বিধান এবং বিবেচ্য
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আজ আমার সঙ্গে কথা বলা উচিত হবে না , এ কথা
তুমি যে ভেবেছিলে ,নিশ্চয়ই তার যুক্তিযুক্ত এক বা একাধিক কারণ আছে। আমি কিন্তু প্রতিদিনকার মতো আজও
সেই রাজবাড়ীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম সকাল থেকে ।
হনুমানের মতো আমারও তো মাছি হবার ক্ষমতা আছে,
লঙ্কাপুরীতে ঢুকতে হবে বলে
ভালোবাসা আমাকে সে ক্ষমতা দিয়েছে ।
মাটিতে পায়ের ছাপ পেলাম ,বাতাসে গায়ের গন্ধ ,তাছাড়া
জুঁইগুলো খুশিতে যেরকম ডগমগ ছিল , তা
বাগানের মালির স্ত্রীর পরকীয়া না দেখলে সম্ভব হতো না।
আজ এদিকে তাকানো উচিত হবে না ভেবে
দৃষ্টিকে শাসন করলে। দৃষ্টিও যে তোমার খুব অনুগত
তা প্রমাণের মতো আচরণ করল ।
না-বলা কথাগুলো , না-দেখা ক্যানভাস গুলো ,
শুকনো হাওয়ার মধ্যে পালকের মতো ভাসতে থাকল।
লঙ্কাপুরীতে প্রহরীদের চাকরি বেঁচে গেল ,দশাননের অহঙ্কারও
অটুট রইল , মাছিটি মাছিই রয়ে গেল ।
মানুষের ঠোঁট
দিশারী মুখোপাধ্যায়
রামপ্রসাদের গান শোনালাম বিস্তর , রামকৃষ্ণের সম্পূর্ণ কথামৃতও ।
মানুষের ঠোঁটের মতো এই পাতি ঠোঁটগুলো তবু মানুষের ঠোঁটের মতোই
রয়ে গেল ।চুমুক দিতে চায় , চুষতে চায় , বলবার জন্য অধীর হয়ে ওঠে
কিছু অর্থহীন কথা ।
এই মানুষের সংসারেই একশোচুয়াল্লিশ ধারার দাপট খুব প্রবল ।
তাই সেই ঠোঁট পারে না চুমুক দিতে , চুষতে পারে না।
বলতেও পারে না কিছু যথার্থ প্রলাপ ।
ঠোঁটের ভেতর জেগে ওঠে বিষক্রিয়া ।জীবাণুর কামড় অনুভূত হয়।
ফুলে ওঠে।একদিন ফাটে , রক্তপাত হয়।
রামপ্রসাদের গান , রামকৃষ্ণের কথামৃত কোনো কাজে লাগে না।
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয় , লাগাতে হয় ব্যথার মলম ।
বিড়ালের কথা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
মাথা দু'রকমের হয়। একটা সংসারী , অন্যটা প্রেমের।
গুরু ও লঘু মস্তিষ্কের মতো এদুটো মাথা ও প্রত্যেকেরই থাকে ,
তবে মানুষভেদে এদের আকার-আকৃতির তারতম্য হয়।
সংসারী মাথা যাদের বড়ো ,সেই সংখ্যাগরিষ্ঠরা, বাজারে খুব দক্ষ হয় ।
অন্যদিকে প্রেমের মাথা যাদের বড়ো ,তাদের কবরে ভালো হয়
লাল গোলাপের চাষ ।
আবার সংসারের মাথা আর প্রেমের মাথা যাদের সমান সমান হয় ,
তারা না ঘরের হয় না ঘাটের ।
সিদ্ধির চেয়ে বুদ্ধিকে যারা বেশি গুরুত্ব দেয় তারা মাঝে মাঝে
প্রেমের মস্তিষ্ককে কেটে ছেঁটে ছোট করে নেয় ,
ভালোবাসার চক্করে পড়ে নিজের বাজার দর কমাতে চায় না ।
অবুঝ বিড়ালটা এসব বোঝেনা , বোঝে না কেন মাঝে মাঝেই তার জন্য
বরাদ্দ মাছভাত দুধভাত বন্ধ হয়ে যায় ।
বাড়ির চারধারে কেঁদে কেঁদে বেড়ায় কেবল ।
কবর-জন্মের ইতিহাস
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কিছু কিছু মানুষের কিছু কিছু বলতে চাওয়া কথা
কোনো কোনো মানুষের বাড়িতে গিয়ে দরজায় করা নাড়ে , অথচ
সে বাড়ির মানুষগুলো দরজা খোলে না , সাড়া দেয় না,
মনে কোনো চাপও অনুভব করে না।
বহুক্ষণ কড়া নাড়ার পরও দরজার বাইরে অপেক্ষায় বসে বসে
সেইসব কথাগুলোর অধিকাংশই মারা যায়
দিতে চাওয়া ও নিতে চাওয়ার তৃষ্ণায়।দু একটি ,যা বেঁচে থাকে
সেগুলো তখন ভুল রাস্তায় যায় ,ভুল বাড়িতে কড়া নাড়ে।
ইতিহাস বলছে - ভুল রাস্তার জার্নি খুব আরামের হয় ,
ঠিকানা জুটে যায় অল্পক্ষণেই ,
দরজাও খুলে যায় মুহূর্তেই ।তখন জন্ম নেয় আরো অনেক ভুল।
তা দেখে অনেক অনেক মানুষের বুকে আর কথা জন্মায় না কখনো ,
বলতে চাওয়া পায় না ,
অনেক অনেক মানুষের বাড়ি অনেক অনেক কবরে পরিণত হয় ।
শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
শুভাকাঙ্ক্ষীরা পরামর্শ দিয়েছেন - কানে শুনো না , চোখে দেখো না,
মুখে বলো না ।
তাদের পরামর্শ মেনে নিয়েছি ।
একদিন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে একটা খর্বুটে লোক বললে- কানের দুপাশে তার শব্দের জঞ্জাল পাহাড় হয়েছে ,
চোখের বাইরে মৃত্যু হয়েছে অনেক নক্ষত্রের ,
আর না-বলা হাজার হাজার কথা বুকের মধ্যে পাথর হয়েছে।
পরামর্শ দেয়ার শুভাকাঙ্ক্ষীরা কিন্তু
কানের মধ্যে কান তার মধ্যে কান লাগিয়ে
শুনে নিচ্ছে আগামী হাজার বছরের কথা ,
চোখের উপর টেলিস্কোপ লাগিয়ে দেখে নিচ্ছে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের অন্তকে ,
আর বলতে যাওয়া কথাগুলোকে
প্রজনন ক্ষমতা বাড়িয়ে ছেড়ে দিচ্ছে হাওয়ায় ।
দেখা ,শোনা ,বলার অধিকার তারা হয়তো সবাইকে দিতে চায় না ।
আমি শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ মেনে নিয়েছি ,
কারণ আমি তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ।
সময় সীমিত
দিশারী মুখোপাধ্যায়
দেখো আমার কলমটা , এতে আর বেশি কালি নেই ।
এখনো যতগুলো মহাকাব্য লিখতে বাকি রয়েছে , সেগুলোর
সব আর লেখা হবে না।
যদি বহুমাত্রার একটা পৃথিবীতে কখনো যেতে পারি
বইগুলো সেদিন একেবারেই প্রিন্টিং বাইন্ডিং হয়েই বার হবে মস্তিষ্ক থেকে ।
এককাপ চায়ের জন্য যদি ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলো
সেটুকু করতে পারব জানি।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে
তোমার উপরের ঠোঁটের বাঁদিকে একটা তিল জন্ম নেবে,
তার সম্পর্কেই আপাতত দু'চার কথা লিখে ফেলতে চাই।
আর সামান্য একটু সময় অপেক্ষা কর ,
সেটুকু সময়ে যদি আগামী দশ প্রজন্মের পরের মেয়েটির
রজঃস্বলার সময় এসে যায় , তবে তাকে
শিখিয়ে দিও তার নিয়ম-বিধি ।
নিজত্ব
দিশারী মুখোপাধ্যায়
রাত্রি আমাকে ভয় দেখায় ,দিন ভয় দেখায় আরো বেশি,
কেবল আমার নিজস্ব-ভয় আমাকে নির্ভীক হবার সাহস যোগায় ।
মেরুদন্ড এর পেছনে একটা স্টিলের পাত বেঁধে দিয়ে
সে আমাকে ভয়ে ভয়ে সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে
তার মাথা চেপে ধরতে প্ররোচিত করে ,
প্ররোচনা শব্দটির বিকল্প শব্দ বেছে নেবার অবকাশও দেয় ।
বহুদূর থেকে তরঙ্গের মতো ,কণাতত্ত্বের ধোঁয়াশার মতো,
অস্থায়ী-স্থায়িত্বের মতো এক বোধ
আমাকে আমার নিজস্ব মূর্তি ভাঙ্গার কৌশল শেখায় ।
রাগ ,ঘেন্না , হিংসে এরা সকলেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে
আত্মশাসনের প্রশিক্ষণ নেয় সময়ের কাছে ।
আমার কবিতা
দিশারী মুখোপাধ্যায়
মৃত্যুর পর একদিন দেখছি এই ঘটনা - আমারই লেখা দুটো কবিতা
হাত ধরাধরি করে হাঁটছিল এক রাজপথে ;
রাজপথটিকে যদি গলিপথ দেখতাম তাতেও কোন ক্ষতি হতো না।
পৃথিবীতে তখনো অনেক মানুষ বেঁচে আছে ,
সেসব মানুষরা তখনও বেশ কবিতা পছন্দ করে ।
নক্ষত্রলোকে নাকি একদিন বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হবে ,
সংশ্লেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় আলো তখন পাওয়া যাবে কবিতা থেকে ,
তেমন হলে আমার কবিতাদুটোর ভবিতব্য কি হবে দেখা যাক ।
বেলুনের মতো ফুঁ দিয়ে মৃত্যুকে একটু বাড়িয়ে নিয়ে দেখলাম
এক মহৎ কবিতার দরবারে হাজির হবে আমার কবিতা দুটো ,
অনাহুত হলেও তারা প্রবেশ করবে সেখানে ,
অন্যান্যদের কবিতা পড়া শেষ হলে
তারাও এগিয়ে যাবে দরবারের মঞ্চের দিকে ।
তারা সেদিকে এগুনো মাত্রই বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যাবে ।
আমি যে একদিন কবিতা লিখতাম - এ কথা ভেবে মৃত্যুর পরও
আমার বেশ গর্ববোধ হবে ।
যদি অলীকও হয় , এই যে এটুকু কল্পনা করতে পারলাম
সেজন্যই এখন কবিতা লিখি
নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেবার লাইনে না দাঁড়িয়ে ।
পলায়ন
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ভাঙ্গা ও শ্যাওলা ধরা একটা ইট ,অদূরে আর একটি ঝামা ,
দু'জনকেই এড়িয়ে গেলাম।
এড়িয়ে গেলাম রাস্তা জুড়ে হল্লা তৈরি করা একটা
কয়েকশো পিঁপড়ের দলকে ।
এখানে লাল ,কালো ,ছোটো ,বড়ো , রাগি ও নিরীহ বিভিন্ন রকমের পিঁপড়ে ছিল ।
সবাইকেই না দেখার ভান করলাম।
একটা অসুস্থ নদী আর মাছের ভেড়িকেও উপেক্ষা করলাম ।
এড়িয়ে চলি বাড়ি ,পাড়া , এলাকা ও দেশ ।
অভ্যাসবশত এখনো শুভেচ্ছা বার্তা লিখি অনেকের জন্য ,
তারপর মুছে ফেলি।
অসংখ্য মানুষের ভালো ও খারাপ খবর এখনো বাড়ির দরজার বাইরে
আসে ডাঁই হয়ে , তাকাই না ,বাইরেও যাই না ।
ফাজিল জলের কাছেও যাই না কদাপি ,
নিজের সঙ্গেও দেখা করি না অনেক কাল ।
একা আছি
দিশারী মুখোপাধ্যায়
অনেকদিন হলো একা রয়েছি ।এক অর্বুদ বছর তো হবেই ।
একা থাকলেই সে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠ ।ভীড়ের মধ্যে থাকে না ।
অনেক ছোটো ছোটো জিনিস আমি ফতুয়ার পকেটে রাখি ,
জানি সেগুলো কখনো কোনো কাজে লাগবে না ।একা থাকলে -
সে যখন আঁকা ,লেখা ,দেখা ও গাওয়ার বিষয় হয়ে উঠতে চায় ,
অস্বীকার করতে চাই । ওই ছোটো ছোটো জিনিসগুলো - আলো ,তাপ ,গতি
কিংবা স্বপ্ন ,কল্পনা ,গণিত - হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করি । সময় কেটে যায় ।
ঘরের দেওয়ালে অনেক দাগ থাকে ।লোকে বলে অবাঞ্ছিত।আমি
বাঞ্ছিত করে নিয়েছি তাদের ।তাদের শরীরের ভাষা আছে।ভাষায় সন্দেশ।
তারা আমার সঙ্গে গল্প করে ,বন্ধুত্ব করে , প্রেম করে । এখন
এই দেয়ালগুলো যদি ভেঙ্গে পড়ে যায় তবুও এই দাগগুলো
আমাকে নিরাশ্রয় হতে দেবে না ।
আরো কয়েক অর্বুদ বছর আমি অপেক্ষা করব ।যদি তখন সে
আর প্রাসঙ্গিক থাকতে না চায় তবে , অনেক ভাঙা কাপ প্লেট
বাসন-কোসনের শব্দ আছে - তাদের নিয়েই কাটিয়ে দেব ।
এখন আর যা সঙ্গে রাখি না
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ঘরের বাইরে ইদানিং প্রায় যাই না ।যদিও কখনো কোথাও যেতে হয়
তবে ও জিনিসটা আর সঙ্গে নিয়ে বার হই না।এমনকি ঘরের মধ্যেও
ওটা নিজের সঙ্গে সঙ্গে রাখি না । হাইড্রোজেনের পরমাণুর মধ্যে যেমন
নিউক্লিয়াস থাকে ,সেরকম মাপের একটা কৌটো বানিয়েছি । তারপর
প্রাণভোমরার মতো সেটাকে ওর মধ্যে ভরে ঘরের মেঝের মধ্যে পুঁতে দিয়েছি ।
এখন আর কথায় কথায় ,যাকে তাকে, যখন তখন কাউকেই আর
সেটা দিয়ে ফেলার ভয় নেই । বাজে খরচ বাঁচানো গেছে।
মাগনায় পাওয়া জিনিসটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নষ্ট করেছ লোকে ।
তারচেয়েও বড়োকথা রাস্তাঘাটে সেই জিনিসটাকে তারা ফেলে দেওয়ায়
দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বাড়ে গ্রাম শহরে ।
জলের অভাবে চতুর্দিকে শুকিয়ে যাচ্ছে গাছপালা আমার মতোই ,
কেবল আমার ঘরের মেঝের পাথরগুলো সবুজ আর নরম হয়ে উঠছে দিনে দিনে ।
বিশেষ কিছু বলার নেই
দিশারী মুখোপাধ্যায়
বিশেষ কিছু বলা আমার উদ্দেশ্য নয় । বলবোই বা কার জন্য ?
বিজ্ঞাপন ও বিপণন বিহীন কথা কেউ উল্টে দেখতে চায় না ।
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে দু দুটো বড় যুদ্ধ চলছে। সেখানে প্রতিদিন,কেবল মানুষ নয় ,
প্রতিটি জীবের বাঁচার অধিকার হয়ে পড়ছে প্রাগৈতিহাসিক ।
বহু চেষ্টাচরিত্রের পরেও আমার বাগানের গাছে ফুল ফুটছে না ,
দিনে দিনে মৃত্যুর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে তারা । এ কথা বলার বা শোনার
কী থাকতে পারে ! জীবনের জন্য লাঞ্ছনা , ভালোবাসার জন্য বেইমানি
আর আস্থার জন্য ঘাতকতা মঞ্জুর করাই বিধেয় ।
সপ্তাহে সাতদিন করে যে ভালোবাসাকে অসম্মান করে তার জন্যই
আমাদের যাবতীয় উৎসর্গ । এ কথা সবাই হৃদস্পন্দনের চেয়েও স্পষ্ট
অনুভব করি বলেই বিশেষ করে আর কিছু বলার নেই ।
আমাকে মানায় না
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আমি আর উল্লসিত নই হে বন্ধু , কারণ ততটা উল্লাস আর
আমাকে মানায় না ।
মিষ্টির দোকানে দই কেনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে যে লোকটা ,
যার অনেকটা বয়স হয়েছে ,তাকে যদি আমার দ্বারা বিকল্পিত করি ,
কেউ আপত্তি করবে না ।
একজন বয়স্ক লোকের চোখে লালগোলাপের লাল
কতটা রক্তিম , অন্তত কতটা হওয়া উচিত
তা কোপার্নিকাস কিংবা গ্যালিলিওরা জানতেন ।
ব্যক্তির জানা সমষ্টির জানার কাছে অশিক্ষিত প্রতিপন্ন হয়।
তাই আমি যা দেখেছি তা কাউকে বলবো না ,
কেবল আপনাকে আমার অস্তিত্ব চুরি করে আমি হয়ে ওঠার অনুমতি দিতে পারি ।
গ্রহ নক্ষত্র বিষয়ক জ্ঞান নিয়ে আমি আর মুখ খুলব না কোনোদিন।
ধ্বংস যেখানে সৃষ্টির সমার্থক শব্দ হয়ে উঠছে সেখানে ছুটবো
আমাকে আর আপনাকে খুঁজে আনার জন্য ।
একটাই মাত্র কবরে আমরা প্রবেশ করব অভিন্নতাকে হাতেনাতে ধরার জন্য ।
আমি আর বিমর্ষ নই হে বন্ধু , কারণ ততটা বিমর্ষতা আর আমাকে মানায় না ।
ওহিও আছে নকুলও আছে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ফাদার দ্যতিয়েনের কথা শুনছিলাম কাল,বাংলাভাষাকে তিনি কীভাবে রপ্ত করেছিলেন ।
অ্যান্টিক্লক চিন্তায় যদি ভাবি ,বাংলাভাষা স্বয়ং কীভাবে তাঁকে আশীর্বাদ করেছিল ।
আর এসব ভাবলে
জন্মান্তরবাদের ধারণার দিকে একবার হলেও তাকাতে ইচ্ছা হয়।
যেসব কথা আমি সারাজীবন লিখতে চাইলাম , লিখতে পারলাম না বলে ,
পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় আমার চাওয়াটি সত্য প্রমাণিত হয় না ।
এক বক্তব্য থেকে যদি অন্য এক বক্তব্যে যাই । মস্তিষ্ক যা প্রতিমুহূর্তেই চায় ,
তবে বলতে পারি প্রতিমিনিটে খুন করি আর প্রতিমিনিটে সাবান জলে হাত ধুই ।
ব্রহ্মাণ্ডে যে সমস্ত রাস্তা প্রতিমুহূর্তে জন্মায় আর হারিয়ে যায়, সেখানে
সরাইখানা আর দিকভ্রান্তি কেউই কাউকে চ্যালেঞ্জ জানায় না ।
আমার হাত ধোয়া জল বেসিন থেকে দুটো নালা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে ,
একটাই রক্ত অন্যটায় পুণ্য ।
কোন কথা কীভাবে বলব , কথা কি আমাকে তা শেখাবে কোনোদিন ?
লোকটাকে দেখা যায় না
দিশারী মুখোপাধ্যায়
লোকটাকে বহুদিন ধরে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । মারা গেছে ?
শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ-মৃত্যুর খবর কোথাও নেই। আংশিকভাবে
কত কিছুইতো হয় স্থানে কালে । সংবাদ মাধ্যম সে খবর
ডজন ডজন গল্পের মধ্যে রাখে না ।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুকেও এবার দেখা যাচ্ছে না বাংলায় ,
বাংলা সে খবরের জন্য কারো মুখাপেক্ষী নয় । বর্ষা যে তার সঙ্গে নেই
পাশে অনুভব করছে বিচ্ছেদ ব্যথা থেকে ।
ইটের জঙ্গল ঘেরা নগরে কোন দূরবীন নেই ।অনুসন্ধানের কাজে
কে তাকে বিষয় করবে ,কে করবে কবিতার অন্ত্যমিল ?
কেউ করবে না গানের গহন বুকে খঞ্জনার বাসা ।
লোকটাকে দেখা যায় না ।লোকটাকে দেখা যায় না।লোকটা কি
আছে তার নিজের বাড়িতে ?
পুরনো একটা বই
দিশারী মুখোপাধ্যায়
এত পুরনো একটা বইয়ের ভেতর কথাগুলো আটকে রয়েছে বুঝতে পারিনি।
ধুলো ময়লা ঝাড়তে গিয়ে হাতে নিয়ে দেখি সেটা অতিরিক্ত ভারী ।
পাতা উল্টাই , উল্টাতে উল্টাতে দেখি পুরনো কথাগুলো ঝকঝক করছে
পাতার ভাঁজে ভাঁজে ।
জল এবং উত্তাপ পেলে তারা এখনই প্রসবিনী হয়ে উঠতে পারে ।
জল থেকে তাদের বার করি ।উচ্চারণ করি। দেখি তারা অনেকেই
আনন্দ মাখা ক্ষীর ।কেউ কেউ আগুনের চেয়েও উত্তপ্ত।তবে তারা
অধিকাংশই ব্যথার গর্ভ থেকে জন্মেছে । প্রত্যেকেই খুব তীক্ষ্ণ ,ধারালো, উজ্জ্বল ;
সাড়া দেওয়ার জন্য উন্মুখ ।
আমার হয়ে এত কথা কে কবে বলেছিল, লিখে রেখেছিল, এই বইয়ের ভেতর ?
সে কি আমিই ছিলাম ?
সময়ের সম্পূর্ণ দেহ দেখতে পেলে এইসব জিজ্ঞাসার সমাধান হবে।
ধর্ষণ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
এবছর গরম খুব বেশি । পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে উষ্ণতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন , - পরেরবার ষাট পার হবে।
গরমে পুড়ে গেছে আমার টবের কাজগুলো । আর্তনাদ করেছে, প্রতিবাদ করেছে
অথচ বাতাসে কোনো কম্পন তৈরি হয়নি ।
ভাঙা তানপুরার কান্নার মতো সেই শব্দ শোনেনি কোনও কল্পনা প্রবণ চরিত্র।
শত কষ্ট সহ্য করেও সঠিক রিডিং দিয়েছে পারদ।
এবছর গরম খুব বেশি। এবছর ভালোবাসার ঘাটতি আরও বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন , - পরেরবার ভালোবাসার অভাব আরো প্রকট হবে।
ব্যথা কাল এসেছিল
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কাল খুব কাছে এসে বসেছিল ব্যথা , কখনো পাসের চেয়ারে, কখনো মুখোমুখি ।
সে তার নিজের সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিল, কীভাবে সে বারবার ,
পাথর যে পাথরই ,তা বলে ,কুড়ুল মেরেছে নিজের পায়ে।অনুতাপ করেনি তবু।
কীভাবে তার কাটামুন্ডু সব অপরাধীদের বিস্তারিত পরিচয় ছাপিয়েছে
বাতাসের ,সময়ের, আলো কিংবা অন্ধকারে শূন্যের শরীরে।
হাত বাড়িয়ে আমি তাকে স্পর্শ করেছি ।দেখেছি সে একই সঙ্গে
মেরুর ঘুমিয়ে থাকা লক্ষ বছরের বরফ আর সূর্যের কেন্দ্রের
একশো পঞ্চাশ কোটি সেলসিয়াস জ্বর ।
আমার সামান্য বুকে কিছুটা জড়িয়ে ধরি ,ঠোঁট দিয়ে শুষে নিই খানিকটা ক্ষত ।
ব্যথা আজ সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত । প্রেমিকের সন্ধানে এখন সে
ব্রহ্মাণ্ডকে ধুনুরি দিয়ে ধুনছে অবিরাম ।
কবিতা এখন বিপন্ন
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কবিতার নামে আজকাল মানুষ কত কীই যে লিখছে আবোল তাবোল
কহতব্য নয় ।
অনর্গল অর্থহীন কথা বলতে বলতে আমি মুখ্য বিষয়ে
স্পিকটি নট থাকি ।
কীকরে যেন জেনে ফেলেছি - মিথ্যেভুক মানুষ সত্যের আঘাতে
বড় কষ্ট পায়।
কাউকে আঘাত দেয়া উচিত হবে না বলে আমিও সকাল বিকাল
আহারের সময় থালা ভর্তি মিথ্যে নিয়ে বসি ।
পদার্থের হীনতা ভরা চরিত্র অনুযায়ী কীভাবে যেন ইট , কাঠ, মাটি ,পাথর ,
পটাশিয়াম ও সোডিয়াম থেকে কিছু বিশেষজ্ঞ প্রাণীর জন্ম হয় ।
তাদের প্রণীত সংবিধান ধরে ধরে কবিতার বাড়িতে ফতোয়া যায়
কীভাবে সে চলাফেরা করবে ,কথা বলবে, ভুরু পল্লবে বিমান উড়াবে - এইসব ।
তবুও মানুষ বড় বেয়াদব , কবিতার নামে তারা অখাদ্যকুখাদ্য ইসতিস
অনর্গল লিখেই চলেছে ।
কবিতার সমাজ বড় বিপন্ন হয়ে পড়ছে । চরিত্র বলে কিছুই থাকছে না কবিতার।
এ সময়ে কিছু কেন্দ্রীয় আইনের প্রয়োগ বড় জরুরী। হায় কেন্দ্র ,
তুমি যে কোথায় ! আমার অন্বেষণ তোমাকে খুঁজছে ।
গান্ধি-আসনের খোঁজ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ফুরিয়ে-যাওয়ার সঙ্গে পরিচয় বাড়ছে আমার , সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে ।
কে যেন সবসময়ই বলছে - গান্ধিজির বসার মুদ্রাটি রপ্ত কর ।
সময়ের বর্তমান অংশটি বলছে - আছ , থাকো। বাক সংযমী হও ;
দৈর্ঘ্য ,প্রস্থ ,উচ্চতার অধিকার ক্রমশ ত্যাগ করো।ত্যাগেই সুখ ।
ফলতো ফুরিয়ে যাওয়াকে নিয়েই এখন গবেষণায় আছি। দেখতে চাইছি
পদার্থের মতো তারও অণু,পরমাণু ,কোয়ার্ক, নিউট্রিনো।
হিসাব করে নিতে চাইছি তার গতি এবং
মানুষের ধারণা-নির্ধারিত অভিমুখকে বদলাতে চাইছি ।
সামনের দিকে অনেক লোকের ভিড় ।অনেক সংশয়, সন্দেহ
সেখানে জড়ো হচ্ছে । নিশ্চয়তার কোন অঙ্কই সেখানে কষা যায় না ।
যেখানে কোনো খবরই কখনো ব্রেক হবে না ,তেমন একটা জায়গা তৈরি করতে চাইছি ।
তুমি বিন্দুবৎ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
যদিও চশমা চোখেই ছিল তবুও অল্পক্ষণের জন্য হলেও
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
জেগে উঠেই দেখছি তুমি জায়গা পরিবর্তন করেছ ।
একটা বিন্দুর কথা চিন্তা করছিলাম । অথবা আমার বাক্য
যদি সত্যবাদী হয় , তবে সেই বিন্দুটি ভাবছিল আমাকে নিয়ে ।
সে তার সমস্ত সম্পদ দিতে চেয়েছিল আমাকে ।
তার সম্পদের পরিমাণ কতটা
তা পরিষ্কার করে দেখার জন্য চোখ বন্ধ করেছিলাম।
ঘুম বলতে ওইটুকুই।
অনন্ত ঘুমে , এমনকি দীর্ঘ ঘুমেও আমি যাব না কখনো।
সম্পূর্ণ আমাকে বেশিক্ষণ ধরে আপ্যায়ন করার মতো
যথেষ্ট জায়গা ও ঐশ্বর্য তার নেই। তাছাড়া
জায়গা পরিবর্তন করে তুমি যার পাশে গেছ
তার বিমানের সময়ও হয়ে এল ।
তোমাকে তো তখন ফিরে আসতেই হবে , এসে দেখবে
আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে অপেক্ষায় আছি।
কেমন হবে , যদি তোমাকে বিন্দু নামেই ডাকি ?
সময়ের বয়স হয়
দিশারী মুখোপাধ্যায়।
সময়ের দাঁত বড় ধারালো,বড় কঠিন।
সময় নয় , একটা লোকের কথাই বলতে চাইছি এখন।
সারাদিনে রাতে সে লোকটা একটা মাত্র গাছের কথাই ভাবে ,
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবে , একবার মিল্কিওয়ে থেকে , একবার এন্ড্রোমিডা থেকে ।
গাছটার নাম সে জানেনা , জানে না গাছটার গণ, প্রজাতি, বর্গ কিছুই ।
বাড়ির লোকেরা , ইস্কুলের বন্ধুরা ,পাড়ার সই সখারা
কে তাকে কি নামে ডাকে , জানে না ।
নিজে একটা নাম ঠিক করে নিয়েছে মনে মনে ,কিন্তু
গোপনীয়তার পবিত্রতা রক্ষার দায়ে
সেই নাম সে জানায়নি কাউকে ।
আমি সেই লোকটার কথা বলতে চাই ,
অথচ সেই গাছটাকে চিনি না , জানিনা ,দেখিনি কখনো বলে
কিছুই বলা হয় না ।
সেই লোকটা একদিন আর কোথাও রইল না ,
গাছটাও রইল না ।
সময়ের দাঁত বড়ো ধারালো, বড়ো কঠিন।
সময়ের সময়
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কখন আসবে ,কোথা দিয়ে আসবে , কীভাবে আসবে -
এসব নিয়ে চিন্তা করা একটা লোক বেনাচিতি বাজারে ঘুরছিল।
বাজার সাধারণত বড়ো রাস্তার দু'ধারেইজন্মায়, বড়ো হয়।
অতিরিক্ত ডালপালা নিয়ে ঝুঁকে পড়ে রাস্তার উপরেই ।
দশমিনিটের মধ্যে তিনটে ভিন্ন ভিন্ন রুটের তিনটে মিনিবাস
এই রাস্তা দিয়েই , ওর চিন্তার উপরে খানিকটা দখলদারিত্ব দেখিয়ে ,চলে গেল ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি , দু'বছর আগেও এই দশমিনিটে এই পথেই
অন্তত তিরিশটা বাস যাওয়ার সময়
ফিরে আসা তিরিশটা বাসের দেখা পেত ।
এখন অনেকেই অটো টোটো করে আসে ,
এবং তাদের আসাপথের দূরত্বও বেশ ছোটো ছোটো ।
চিন্তা নিয়ে লোকটা বাজারে ঘুরছিল। সে লক্ষ্ করল -
আরো অনেক লোক আরো অনেকরকমের চিন্তা নিয়ে
ঘোরাফেরা করছে তার চারধারে ।
পশ্চিমদিকে হাঁটা রাস্তাটা হঠাৎ যেখানে উত্তর দিকে ঘুরে গেল
সেখানেই সুশীল নাগের বাড়ি ছিল ,
সুশীল নাগ কবিতা লিখতেন আর এই বেনাচিতি বাজার থেকেই সবজি কিনতেন ।
ঠিকানার রসায়ন
দিশারী মুখোপাধ্যায়
এ কথা ঠিক নয় যে আমিই কেবল ঠিকানাকে বারবার ভুলে যাই ,
ঠিকানাও আমাকে ভুলে যেতে চায়
এবং তার ভুলে যাওয়ার মধ্যে কিছু যুক্তিযুক্ততা আছে ;
তা বুঝিয়ে দেয় বারবার ।
ঠিকানা ভুলে যাওয়া একজন মানুষ নিউটনের আপেল হতে পারে না ,
আপেলকে মনে না-রাখা ঠিকানাও অভিকর্ষ হয়ে উঠতে পারে না ।
ঠিকানা সম্ভবত বেশিক্ষণ স্থানু থাকতে চায় না , আমিও তাকে
একই বাস-টার্মিনাসে একই জায়গায় দেখতে চাই না।
সময় এবং স্থান কখন কোথায় আমার প্রিয়জন হয়ে উঠবার জন্য গোলাপ হবে
তা নির্ণয়ের জন্য একটি গণিত আছে ,
আর গণিত সবসময়ই ভালোবাসার বশ্যতা স্বীকার করতে চায় ।
ঠিকানা এবং আমি , আমি এবং ঠিকানা - এ নিয়ে একটি বিস্ময়
ব্রহ্মাণ্ডকে গানের ক্লাসে ডাকে ।
টাইম অ্যান্ড স্পেস
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ওইখানে একটা শিমুল গাছ আছে । এখন ওর নিচে
কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে ।
আনুমানিক বিশ বছর আগে আমি যখন এখান দিয়ে
কোথাও যাচ্ছিলাম, সেদিনও
একটা শিমুল গাছ ছিল এখানে ।
কেউ একজন মানুষও দাঁড়িয়ে ছিল তার নিচে ।
এখানে সম্পর্কহীন অনেক আলো চোখের পীড়াদায়ক।
ওখানে কোনো আলো নেই , সেদিনও ছিল না ; তবু
চোখে কোনো কষ্ট অনুভূত হয়নি ।
কিছু রশ্মি দিয়ে একটা জগৎ গড়ে ওঠে। কিছু রেখা দিয়ে।
দুটো মানুষের মধ্যে কুড়ি বছরের একটা স্থান ও সময় ছিল ।
সেই স্থান অসীম এবং সেসময় অনন্ত হলে আরো ভালো হয় ।
অজ্ঞাতবাস
দিশারী মুখোপাধ্যায়
তোমাদের সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে আমি নির্জনে চলে এসেছি ,
নির্জনের নির্জনতা সেকথা জানে এবং কোনোরকম চালাকি না করেই তা মানে ।
এখানে অন্তত একটা গাছ থাকার কথা ছিল ,
অল্প হলেও কিছু সবুজ ঘাস থাকার কথা ছিল মাটিতে ,
তারা কেউ নেই । কেবল আমি স্বেচ্ছায় একা ।
যে প্রকৃতই আকাশ সে নিজেকেও খুঁজে পায় না ,
নিজের ছায়া পড়ে না ,
প্রতিধ্বনি আসার ভয়ে চিৎকার করতে পারে না।
চোখ বন্ধ করে আমি কিছু কল্পনা করতে চেয়েছিলাম , -
সে বার পুঁইশাকের চাষ ভালো হয়নি ,
কলার মোচার মধ্যে ফুলের সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল ,
কিংবা মাঠের মধ্যে আলপথের শরীর একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে পিচের হয়ে গিয়েছিল,
এইসব সংলগ্ন ও অসংলগ্ন ঘটনার তাৎপর্যহীন কথা ।
অথচ কল্পনা করতে পারিনি ,
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজের অজান্তে।
এখন এখানে নির্জনতাকে একা রেখে
তোমাদের কাছে আর ফিরে যেতে পারছি না ।
ঘরের বাইরে এবং ভেতরে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আমার ঘরের বাইরে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে
এবং তার চারধারে হালকা মাপের বৃষ্টি পড়ছে ।
অবশ্য মুষলধারেও হতে পারতো ।
যারা বাড়িতৈরীর কাজ করছে তারা প্রায় প্রতিক্রিয়াহীনভাবে ভিজছে ,
বর্ষা আসার এক সপ্তাহ আগেও যারা পঞ্চাশডিগ্রিতে পুড়েছিল ।
আমি ঘরের ভেতরে যেভাবে আছি তাতে আমাকে মৃতদেহ বললেও ভুল বলা হয় না ।
একটা একশো ওয়াটের আলো জ্বলছে , সেজন্য
যে ইঁদুরটা বই কাটছে তার একটা অনেক বড় ছায়া পড়েছে ঘরের দেয়ালে ,
একটা পানিয়ের বোতলও তার নিজের ছায়াকে দেখে
আকাশে কুসুম চাষের স্বপ্ন দেখছে ।
আমার ঘরের বাইরে দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল ।
শব্দ শুনে মনে হচ্ছে সেটা চার চাকার গাড়ি।
চালকের পাশের সিটে কে বসে আছে তা ভাবতেই পারি,
কিন্তু ভাবছি না ।
যে ওষুধের স্ট্রিপটা হাতে নিয়ে নাড়ছি
ঘুমিয়ে পড়লে সে বয়ান দেবে ।
একটা পঁয়ষট্টি বছরের লোক
দিশারী মুখোপাধ্যায়
একদা একসময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক সন্তান কবিতা লিখতেন ,
কবিতা লিখে তিনি বেশ খ্যাতিও পেয়েছিলেন ।
তারও অনেককাল আগে ভুসুকুপাদও পদ রচনা করতেন ,
এবং আরও কেউ কেউ ।
দেয়াল ধরে হাঁটা শিখতে শিখতে একটা মানুষের
হঠাৎ পঁয়ষট্টি বছর বয়স হয়ে যায় ,
সে মানুষটা কোনদিন কবিতা লেখার কথা ভেবে ওঠেনি,
সাইকেল চালানোর কথাও ।
অনেক অনেক মানুষ দল বেঁধে বেঁধে মেলায় যায় ।
দিনে দিনে মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়েছে ,মেলার সংখ্যাও ।
সেখানে অনেক মানুষ নাচে ,গায় ।
লোকটার অনেকক্ষণ ধরে খুব জল তেষ্টা পেয়েছে ,
কিন্তু জল জিনিসটা কী , কোথায় পাওয়া যায় ,
সে জানে না ।
সমস্যার প্রেমে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ওদের কাল সমস্যাটার কথা বলেছি , ওরা স্বচক্ষে দেখেও গেছে ,
সমাধানেরও আশ্বাস দিয়েছে ।
আমি এই সমস্যাটার সঙ্গে একসঙ্গে বাস করছি দু'দশক,
যদিও সে আমার অনেক ক্ষতি করেছে , কষ্ট দিচ্ছে আজও ।
তবুও ওর উপরে একটা মায়া পড়ে গেছে ।
ভাবছি সমাধানের পর ওকে ছাড়া থাকব কীভাবে ।
আলোর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করিনি কখনো ,
সেও চায়নি আমার সঙ্গে পরিচিত হতে ।
অন্ধকার জ্বেলে জ্বেলে রাস্তা হেঁটেছি আজীবন ,
এখন সেও আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না ।
একটা নতুন পৃথিবী বানিয়ে নিয়েছি আমি ।
ভাবছি সমস্যাটা যেমন আছে থাক ,
ওকে আর বিব্রত করার দরকার নেই । আমাকে ছেড়ে
ও বেচারাই বা যায় কোথায় !
ভেবেছিলাম ওরা আসবে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ভেবেছিলাম ওরা আসবে , এসে বলবে, - এটা কোন ব্যাপার নয় , এখনই ঠিক করে দেব ।
সারাদিন অপেক্ষায় থাকলাম , দরজা বন্ধ করলাম না একবারও ,
বাড়ি ছেড়ে বার হলাম না , পাড়ার দোকানেও গেলাম না দুধের প্যাকেট আনতে ,
পাছে ওরা এসে ফিরে যায় ।
অনেক লোক এসেছিল এই পথে উত্তেজিত গলায় কথা বলতে বলতে ,
গলির বাঁকে কোথায় চলে গেল ।
একটা বুলডোজার মেশিনও বুক ফুলিয়ে গেল সেই পথে।
কয়েকজন নিরীহ মানুষ বেরিয়ে এলো সেই গলি থেকে ভয়ার্ত ভাষায় ।
এরকম কিছু ঘটনার যাওয়া আসা চলতে থাকল , তারা এল না ।
যারা এসে সব ঠিক করে দেবে বলেছিল।
আমি ঘর বার করছিলাম , অনেক মানুষই এরকম করে।
এরকম করতে করতেই ভোট এসে যায় ,
লাগু হয়ে যায় কাঙ্খিত আদর্শ আচরণ বিধি ।
ক্লিষ্ট আষাঢ়
দিশারী মুখোপাধ্যায়
সমস্ত শরীরে আমার জ্বালা অনুভূত হচ্ছে । মনের জ্বালা কি তবে
ত্বকের উপর ভেসে উঠছে ? এই মন , এই শরীর - কাউকেই তো
দাবি করিনি নিজের বলে । তবে এই জ্বালা দিয়ে কে আমাকে কী বুঝাতে চায় ?
এবারের আষাঢ়কে যেভাবে দেখছি আকাশে , - মেঘ আসে , অন্ধকার হয় ,
অথচ ঝরে না বৃষ্টি ।আষাঢ়ের অপরাধ ছিল বুঝি কিছু !
হে আষাঢ় , হে আকাশ , - তোমাদের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে
অমলিন থাকো অনুক্ষণ । পৃথিবীই একমাত্র বন্ধু তোমাদের।
তোমাদের মধুক্ষরা প্রেম যেন ওষুধের মতো কাজ করে আমাদের
শরীরের , মনের চর্মরোগে ।
সমস্ত শরীরে এত তৃষ্ণাহীন কাতরতা কেন ? আমি কি প্রেমের কাছে যোগ্য হতে পারিনি কখনো ?
অন্তর্দ্বন্দ্ব
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আমার সমস্ত কথা আমি নিজে বলি না , অন্য কেউ বলে।
কে সেই অন্যজন ? তাকে চিনি না, জানি না , দেখিনি কখনো ।
আমার সমস্তটুকু আমি নই । গন্ধরাজ মাখা সকালের আলো
যে-আমাকে পাঠালে , সেই-আমি কীভাবে করাত হয়ে উঠি !
শোকহীন তরুর কাছে মাথা নিচু করি , তবুও কীভাবে যেন
দাঁতের মাড়ির নিচে বিষ জমে ওঠে , তীব্র হয় কামড়ের স্পৃহা !
যে কথা আমার বুকে আশ্রয় নেয় , গলা থেকে বমির মতো বার হয়ে আসে ,
আমি কি তাদের জন্মদাতা ? অস্পষ্টতা ক্রমে সন্দেহের মতো গাঢ়
নাইট্রিক অ্যাসিড হয়ে ওঠে ।
পবিত্র ঘুমের নিচে , স্পষ্ট বুঝতে পারি , যে সমস্ত কথা আমি নিজ মুখে বলি ,
একটিও আমার কথা নয় ।
ভুল আমার প্রিয়তম
দিশারী মুখোপাধ্যায়
ভুলের সংখ্যা কম হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ক্লোরোফিল কমে গেছে।
পৃথিবী কেবল আমি দিয়ে গড়া নয় , একটিমাত্র আমি আর কোটি কোটি তুমি ।
গণিত নিজে কোনোদিন অঙ্ক হয়ে উঠতে চাইনি , সুদ বাড়িয়ে বাড়িয়ে
নিজের গুরুত্ব কমিয়ে ফেলার নেশা সে রপ্ত করেনি ।
যে সমস্ত সাদাবকের ডানা আকাশের আত্মপ্রত্যয় বাড়ায় ,তারা আমাকে
শেখায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কাকে বলে । যত এন-তম সংখ্যক 'তুমি' রয়েছ
আমার আঁকা না-আঁকা ক্যানভাসে
'আমি' শব্দটির উপস্থিতির জন্য তারা যেন ভুল বুঝ না তোমাদের প্রিয় ভাষাটিকে ।
সবুজ পাতা দিয়ে অহংকার ঢেকে দেওয়া গাছ , রঙিন মাছের শরীর দিয়ে
বিনয়ী হয়ে ওঠা সমুদ্র, কুবোপাখির ডাক দিয়ে তৈরি হওয়া এক
সম্পূর্ণ নির্জনতা , - তোমরা আমাকে আবার ভুলের হাতেখড়ি দাও ।
পর্দার ছল
দিশারী মুখোপাধ্যায়
এখানে এই পর্দাটি লাগানোর আয়োজন করেছ তুমিই ,
যাতে ওপাশে কি আছে তা দেখা ও জানার জন্য
উদ্যম শব্দটি একটি মানুষকে খানিকটা উদ্যমী করে তুলতে পারে ।
শূন্য যেখানে সবকিছু বমি করেছে গ্রাস করবে বলে ,
সেখানে আমি সাড়ে তিনহাত জমি জোগাড়ের জন্য পরিশ্রমী হই , -
এ তোমার একান্তই রোমান্টিক চাওয়া ।
এই পর্দাটির মতোই সমস্ত জড় এবং সজীব বস্তুকে নিয়েই
আমাদের বন্ধুরা দ্বিধাবিভক্ত ,
তারা অনেকেই সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি করতে চায় ,
আবার অনেকেই স্বয়ংক্রিয় শব্দটির কার্যক্ষমতাকে
অক্ষুন্ন রাখতে চায় ।
আমি কেবল ছবি আঁকতে থাকা একটি বালককে দেখি।
একদিন এই পর্দাটি এখানে থাকতে চায় বলে তোমার কাছে আবদার করেছিল ,
তুমি তার আবদার পূরণ করেছ । আর তাকে সামনে রেখে কখন কী করবে
তা আমি আমার অজ্ঞতা দিয়ে সম্পূর্ণ জানি অনেক আগেই ।
অনেক কথার মৃতদেহ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
অনেক কথার মৃতদেহ পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।
মানব-ডিভাইসগুলো তার উপর দিয়ে হেঁটে যায় ,
কোন মর্মর-শব্দ ওঠে না ।
মৃতদেহগুলো মান্ধাতা ,
প্রাগৈতিহাসিক লিপিগুলো তাদের কথা শোনাতে পারে না ।
একটি বুক আর ভয় থেকে জন্মানো কিছু দুরুদুরু
বহুকাল পরস্পরকে দেখেনি ,দেখা হবার সম্ভাবনাও আর নেই তাদের ।
অথচ দেখা হলেই
অনেক সজীব কথা জন্মাতে পারে ।
দশ বা একাদশ মাত্রার কোন সভ্যতায়
শব্দকোষ বলে কিছু থাকবে কি ?
একটি কথার সঙ্গে আরেকটি কথার শুভ বিবাহ
থাকবে কি কখনো ?
অনেক কথার মৃতদেহ নিয়ে এক বিপন্নচাষী
ডিভাইসের জঙ্গলে ধুঁকছে ।
গ্রহণ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
পিঠের পিছনে একটি ক্ষতর জন্ম হয়েছে ।
পৃষ্ঠবান ব্যক্তিটি তাকে দেখতে পাচ্ছে না , অথচ
সেটার উপস্থিতি টের পাচ্ছে স্পষ্ট । পিছন থেকেই
সেটা তার নিজের ভাষায় কথা বলছে লোকটির সঙ্গে।
অধিকাংশ কথাই হুমকি, ধমকি, গালাগালি ।
সামনের দিকটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ,দাড়ি-গোফ কামানো
মাথার চুলে পরিপাটি করে বজায় রাখা কয়েক দশকের পুরনো টেরি ।
ব্যথা , যন্ত্রণা, পুঁজ ,বদরক্ত - এইসব নামের কোনো দুষ্টু লোককে
দেখা যায় না রাস্তাঘাটে কোথাও ।
পিঠের পেছন থেকে একটা গ্রাস , হয়তো
ডাইনোসরের মতো তার চোয়াল , ভয় দেখাচ্ছে সূর্যগ্রহণের ।
স্বরূপ
দিশারী মুখোপাধ্যায়
একটি লোকের কথা জানি , যার সম্পর্কে কিছুই জানিনা ।
খারাপ , অযোগ্য , কাপুরুষ , অপদার্থ - এইসব শব্দগুলোকে
অধিকার দিয়েছে সে তাকে তাদের উদাহরণ হিসাবে দেখাবার ।
লোকটা হাটে না , হাঁটতে চায় না , অলস এবং অবিশ্বাসী।
ভয় দেখালে সে যখন জায়গা পরিবর্তন করে , তার ছায়া পড়ে না ,
অর্থাৎ আলোকে সে প্রাপ্য স্বীকৃতি দেয় না।
তাকে কিছু ব্যথা দিলাম , কিছু মরুভূমি ; কিছু মেয়োসিস দিলাম , কিছু আয়ুক্ষয়।
সে নির্বিকার , নিরাসক্ত । বেয়ারা , বেখাপ্পা ।
আনন্দে ও বিষাদে ।
বাইরে বেরিয়ে গিয়ে ক থেকে ম পর্যন্ত নাম ধরে ধরে ডাকি ,
গালাগাল দিই ।
অত্যন্ত নিমরাজী হয়ে ক্ষীণস্বরে সাড়া দেয় ভেতর থেকে,
অত্যন্ত ভেতর থেকে।
শুনতে পাই শুধু মাত্র আমি ।
কান্না
দিশারী মুখোপাধ্যায়
কত জায়গায় কত যে কান্না পড়ে আছে আমরা জানি না।
ঘরে ,দুয়ারে, উঠোনে ,রাস্তায় - জলরঙের কান্নার পুরুস্তর পড়ে আছে চতুর্দিকে ।উপমা হিসাবে
মেরুপ্রদেশের বরফের কথা ভাবতে পারো । তবে তাকে শুধু
অদৃশ্য হবার সুযোগ দিতে হবে।
পেঙ্গুইন যেন জানতে না পারে কোথায় সে হাঁটছে , কার বুকে।
সামান্য একটু সাধনা করো , শুধু একটি মনুষ্য জীবন ব্যয় করে ;
স্বচক্ষে দেখতে পাবে , কত কান্না যুগে যুগে নষ্ট হয়েছে ।
কত কান্না আজও যত্রতত্র , উপেক্ষিত । পায়ে পায়ে
মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমরা তৈরি করছি দীর্ঘ এক তথ্যচিত্র অবমাননার ।
কান্না বড়ো ধৈর্যশীল , দাবিহীন , প্রতিবাদহীন ।
সংসারী ভনিতার মতো তার কোনো নোনা স্বাদ নেই ;
কান্নার বিকল্প শব্দ হতে পারে একমাত্র প্রেম।
আমার সাম্রাজ্য
দিশারী মুখোপাধ্যায়
চতুর্দিক থেকে ,যতদূর পর্যন্ত ,নিজেকে গুটিয়ে নিতে পেরেছি
ততটুকুই আমার সাম্রাজ্য ।
তুমি যদি কখনো তা আবিষ্কার করতে পারো , দেখবে
সে সাম্রাজ্যে জ্বলজ্বল করছে আমার অনুপস্থিতি ।
নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে আমি তোমার জন্য একটা ঘর বানাই ।
সেখান থেকে একটা ছোটো রাস্তা , অন্তরীক্ষে যাতায়াত করার চ্যালেঞ্জ ,
একটা জানালায় রাখি একটা ছোটো অরণ্য ।
আনুষঙ্গিকভাবে আর যা যা কিছু থাকার কথা
এনে রাখি দশকর্মা ভান্ডার থেকে ।
একটা বাংলা অভিধান রাখি তোমাদের লেখালেখির সুবিধার্থে ,
এখানে শব্দ সংখ্যা বাড়িয়ে চলি প্রতিদিন ,
কেবল 'আমি' , 'আমার' জাতীয় কোনো শব্দ রাখিনি
তোমার অভিমানের কথা বিবেচনা করে ।
যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় , ধানের শীষ , গোরুর গাড়ির চাকার দাগ ,
রকেটের সাদা সুদীর্ঘ আস্ফালন , আন্তর্জালের ওয়াইফাই
এবং আমার অন্ত্যেষ্টি , ততদূর পর্যন্ত আমার সাম্রাজ্য ।
মেলার মধ্যে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম একা।মেলা যেমন ব্যস্ত থাকে নিজেকে নিয়ে ,সেভাবে এটা ওটা দেখছিল, নাড়ছিল হাত দিয়ে । একহাতে গরম জিলাপি খেতে খেতে অন্য হাতে পছন্দ করছিল প্লাস্টিকের ফুল।ইমিটেশন গয়নার দোকানে ঢুকে হরেকরকমের হার গলায় ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিজেকে দেখছিল আয়নায় । সাবানের রঙিন ফেনা উঠছিল চতুর্দিকে, মুহূর্তকালের জীবনে কানায় কানায় দেমাক নিয়ে ।
মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম একা ।হাজার হাজার লোকের স্রোত চলছে। ধাক্কা মারছে , ঠেলে দিচ্ছে , ফেলেও দিচ্ছে কখনো । যে-আমি পড়ে গেলাম সে-আমিকে অন্য এক-আমি হাত বাড়িয়ে টেনে তুলল । চায়ের ভাঁড় আর ভাজা বাদামের খোসার পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে ক্যামেরা ছাড়াই ছবি তুলছিল একটা লোক ।
এ পৃথিবীতে কোথাও একটা লম্বাচুলের বিনুনিকে দেখা যায় না , একথা পরিপূর্ণভাবে জানা সত্ত্বেও যেন কেউ আশার সিরাপ বানাচ্ছিল মনে মনে ।
আতর
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আগর গাছ একটি নিরীহ উদ্ভিদ । শরীর-স্বাস্থ্য পাতা -পল্লব দেখে মোটেই তাকে অহংকারী মনে হয় না , মনে হয় না কঠিন ও হৃদয়হীন । আতর সন্ধানীরা তাই ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য তাকেই বেছে নেয় ,জানে আহত যীশুর কান্না ভেতরে ভেতরে সুগন্ধিতে পরিণত হয়।
হাজার হাজার বছর ধরে তার সেই মনোহারী কান্না বিক্রি করে কোটিপতি হয় বণিকরা।
অপমান কর ,আঘাত করো, লোহার রড পুঁতে দাও আমার বুকে । সেই ক্ষতস্থান থেকে যেন বার হয় মৃতসঞ্জীবনী।
প্রেমের মতো
দিশারী মুখোপাধ্যায়
তোমার কাছ থেকে মন সরিয়ে নিয়ে একটি কবিতার বইকে দিলাম ,
কবিতা সে মন নিল না ।
একটি কাঞ্চন ফুলকে দিলাম , নিল না ।
ব্যাঙ্কের পাসবইকে দিলাম , নিল না ।
ফিরিয়ে দিল রাস্তাও ।
একদল বক উড়ে যাচ্ছিল ,
কেউ তাদের প্রাচীন বলবে তা না ভেবেই ।
একটুকরো ঘাস দূর্বা নামের পরিচয় নিয়ে গাইছিল ,
জানতো কেউ তাকে শিল্পী বলবে না ।
শেষে সেই হাজার জনের ফিরিয়ে দেয়া মনকে
তোমার কাছেই পাঠিয়ে দিলাম ,
তুমি কেমন ব্যবহার করবে তার সঙ্গে তা না ভেবেই ।
উৎসবের আড়ালে
দিশারী মুখোপাধ্যায়
তোমাদের উৎসবের উঠোন অতিক্রম করে এল একটা লোক
কোনোক্রমে ,
হাজারো আলোর মাঝেই কোথাও একবিন্দু অন্ধকার ছিল
ধাঁধিয়ে যাওয়া অনেক চোখের আড়ালে ,
সেটুকুকেই রাজবেশ করে গায়ে জড়িয়ে ।
এখন লোকটা সেই অন্ধকারের সবটুকু নিচ্ছে ,
আর অন্ধকারকে তার নিজের সবটুকু দিচ্ছে ।
দেওয়া নেওয়ার জন্য আনকরা কিছু শব্দবাক্যের প্রয়োজন উপলব্ধি করছে ,
কিন্তু সেসব তার জন্য সহজপ্রাপ্য হওয়ার নয় বলে
পবিত্র গরিবি দিয়ে এসরাজ বাজাচ্ছে ।
লোকটা এখন একটা ছোট্ট অপরিচিত গাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে ,
তাকে নিজের হৃৎপিণ্ডটা বার করে খেলতে দিয়েছে ,
আর অনাবিল আনন্দে সবুজ হয়ে উঠছে ।