হে শূন্য হে নিষাদ
(১)
বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য
ডাক দিচ্ছ তুমি ,
সেই ডাক ছুঁড়ে দিচ্ছ স্পাইরাল মোডে।
আমার জিজ্ঞাসা , যা তোমার উদ্দেশ্যে পাঠাব না,
সে কেবল আমাকে বিদ্ধ করছে ।
কে ,কবে ,কোথায় ঢুকতে পেরেছে ? - এই বলে ।
আমার প্রিয় সূর্য ও তার সংসার
একটি গ্যালাক্সির মধ্যে ঘুরছে ,
আর ঘুরতে ঘুরতে
অন্য গ্যালাক্সির দিকে ছুটে চলেছে ।
সেই ছুট-প্রিয় অস্থিরতার মধ্যেই
তথাকথিত এক স্থিরতার আসনে বসে আছি আমি ।
ভেতর বার বলে কোথাও কিছু কি আছে ?
(২)
চল্লিশ মিনিটের ক্লাস শেষ হয়ে এলো ,
জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে তাকাতে গিয়েই
সময় যে একচামচ চিনির চেয়ে বেশি নয়
বোঝা যায় ; এটুকু সময়ে
কীভাবে বোঝাবে নন্দনতত্ত্বের গায়ে ছাতা পড়ার কথা ,
কীভাবে খোঁজাবে জ্যোতিষ্কলোকের সাম্প্রতিক মিটিং !
হাল্কা একটা যন্ত্রণার ছাপ পড়ছে সাদা কাগজে ,
সেটা মুক্তি হতে পারে ,
অন্তর্ভুক্তিও হতে পারে কোনো নতুন সমস্যার।
সমস্যা ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে কিনে আনা সামান্য জীবন
এক আলোকবর্ষের কতটা দেমাক ভাঙতে পারবে ,
মাত্র এই চল্লিশ মিনিটে ?
(৩)
কোনোকিছু পেরে ওঠা ইদানিং
আমার নাগালের বাইরে গিয়ে
একটি পূর্ণচ্ছেদের কাছে ঘোরাঘুরি করছে ।
পূর্ণচ্ছেদকে ইংরেজিতে ফুলস্টপ বলা হয়,
লেখা হয় একটি ডট-বিন্দু দিয়ে ।
এই ডট-বিন্দুর বিলিয়ন ভাগের এক অদৃশ্য-বিন্দুতে
এই ঘরসংসার নিয়ে আমাদের চলে যেতে হবে ।
স্পেস-শূন্য সেই অকল্পনীয় জায়গার ভেতর
সহাবস্থান হবে আমাদের ,
পরকীয়া করা বা না করার
কোনো উপায় বা কল্পনা তখন থাকবে কি ?
যে শুচিতা এখন তোমাকে ভর দিচ্ছে ,
যে অসুস্থতা এখন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে ,
তারা তখন থাকবে কোথায় , কার শরীরে !
(৪)
দুই অস্তিত্বের জরাসন্ধ আমি ,
দুভাগে বিভক্ত হয়েছি ফের , - বস্তু ও অবস্তু ।
চোখের অসীম তৃষ্ণা নিয়ে
দূরবীক্ষণের ধ্যানে তাকিয়ে রয়েছি
দুইটি আসনে ,
একদিকে হাবল
অন্যদিকে জেমস ওয়েব।
বিলিয়ন বিলিয়ন দূরবর্তী এক পড়শি-গ্যালাক্সি থেকে
চিঠি পাঠিয়েছে কেউ ,
ভায়া মহাশূন্যের পোস্টঅফিস।
কখনো কণা ,কখনো তরঙ্গ রুপী সেই চিঠি
বাঁচিয়ে তোলার জন্য
হত্যা করতে আসছে আমাকে ।
সে চিঠির লিপি কীভাবে উদ্ধার করব আমি !
(৫)
পরিণতিটা কেমন হবে তাই ভাবছি ,
আমার পরিণতি ।
কিছু কিছু মানুষ কিছু কিছু মানুষকে ঘৃণা করে ,
তুমিও আমাকে ।
ধরা যাক নূরজাহান জাহাঙ্গীরকে এক একক পরিমাণ
ঘৃণা করলেন এবং ফল স্বরূপ
জাহাঙ্গীর তাঁর থেকে ছিটকে পড়লেন এক যোজন দূরে।
ঘৃণার পরিমাণ দুই একক হলে
ছিটকে পড়ার দূরত্বও হবে দুই যোজন।
এভাবে দূরত্ব বাড়তে থাকবে
ঘৃণা বাড়ার সঙ্গে সমানুপাতিক হারে ।
কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি কণা বৃত্তাকার ,
গ্রহ উপগ্রহের কক্ষপথও বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার ,
ইউনিভার্সের সব জ্যামিতিই যেমন।
ঘৃণার পরিমাণ পঞ্চাশ এককের থেকেও বাড়লে
ফলাফল কী হবে !
(৬)
একটি নিমের গাছে সারারাত রাত লেগে থাকে
আমি জানি ,
যখন সে সকালের কাছে তাকে রেখে
সে-রাতের মতো চলে যেতে চায় -
লোকে তাকে ভোর বলে ,
আমি জানি ।
এ জীবনে ভোরে উঠে কবিতা লিখিনি কখনও ,
আজও লিখব না । শুধু
অ্যান্ড্রোমিডার কথা ভাবছি এখন।
মিল্কিওয়ের দিকে যাত্রা তার শুরু হয়ে গেছে ,
অনতিবিলম্বে, মাত্র পঁচিশ লক্ষ বছর পর
পরস্পরকে কাছে পাবে তারা ,
দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসা দেবে ।
হুস করে সে মাহেন্দ্রক্ষণ এসে পড়বে
কে জানে কখন ! তাই
অপেক্ষায় বসে আছি ভোররাতে ,নিম গাছের নিচে ।
গ্যালাক্সি-প্রেমের কথা , মিলনের কথা
লিখব কি ?
(৭)
বাসে চেপে দশ মিনিটের পথ গেলেই
সেখানে যাওয়া যায় ,
যাওয়া হয় না তবু সেখানে ।
আকর্ষণ বা বিকর্ষণ , কোনো বলই
সে ঘটনা ঘটার বা না ঘটার দায় নিতে চায় না ।
গন্তব্যকে ভয়েজারে চাপিয়ে
সৌরজগতের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি ,
এখন দূরত্ব দিয়ে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে অটুট।
দূরত্বের বাংলা মানে
রঙিন, মধুর , তীব্র নৈকট্য। মহাকাশ জানে ,
সূর্যের সংসার জানে ,
নীহারিকা জানে এই কথা ।
(৮)
সেদিন মঙ্গলের লাল মাটির উপর হাঁটছিলাম একা ,
অক্সিজেনের পরোয়া করিনি । কারণ
সঙ্গে ছিল অক্সিটোসিন নিঃসৃত গাঢ় ,স্বচ্ছ ভালোবাসা।
এককালে সেখানে যে নদী বাউল গাইত
তার সর্পিল সমাধির পাশে নেমে আসছিল বিকাল।
আমার একাকিত্বের সেই বিশুদ্ধ অনুভূতিটি
মঙ্গল ছেড়ে হঠাৎ নেমে আসছিল তোমার বাড়িতে ,
তুমি তখন একটা পুরনো ক্ষতচিহ্নকে আদর করছিলে চুপিচুপি ;
জল্লাদ-পৃথিবীর নজর এড়িয়ে ।
কবিতার প্রতিটি পাঠক খুব দৃঢ়ভাবে জানে
মঙ্গলেই ফিরে গেছি আমি তৎক্ষণাৎ।
(৯)
শীত তখন যাই যাই করছে । একটি মেয়ে ,যে
রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল , রাস্তাকে পথ হবার আনন্দ
উপলব্ধি করাতে করাতে
কচি কচি বসন্ত উঁকি মারছিল তার সারা শরীরে ।
তুমি আমি , আমরা দুজনেও তখন
আমাদের ছোটো উঠোনে পায়চারি করছিলাম
হাতের আঙুলগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে খোলামেলা
মেলামেশার সুযোগ দিয়ে ।
পায়ে পায়ে বৃহস্পতি অতিক্রম করছি যখন
তখন সেখানে তুমুল হীরক-বৃষ্টি। অতি সাবধানে
আমাদের নোনা ঘাম আর তার
অতি মূল্যবান যৌনগন্ধকে
দুজনের শরীর দিয়ে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে ,
(যাতে হীরকের স্তুপে চাপা পড়ে না যায়)
মহাশূন্যকে পূর্ণতার আস্বাদ দিলাম।
(১০)
প্রবল ধুলোঝড় আর ধূমকেতু-প্রপাত তখন অনন্তে ,
সেসব এড়িয়ে আর পেরিয়ে
কয়েকজন সুহৃদ-নক্ষত্রের হাত ধরে
আমরা পৌঁছে গেলাম ভার্গো-ক্লাসটার ,
সেখানে তখন কবিতা পাঠের আসরে মগ্ন সবাই।
আমাদের পৃথিবী সেখানে কবিতা পড়ল ,
কবিতা পড়ল আমাদের সূর্যও।
আকাশগঙ্গার আরও অনেক গ্রহ নক্ষত্রও
নিজ নিজ কাব্য-গন্ধের ধূপ জ্বালালো ,
তুমি আমি ,আমরা দুজনেও ,আমাদের হৃদয় পড়েছিলাম
সেই কবিতা উৎসবে ।
চলো , আবার একদিন সেখানে যাই
আমাদের নতুন কবিতার বই নিয়ে ।
(১১)
কিছু দংশন আমার শরীর মনকে
কাল বেছে নিয়েছিল ,
তাদের তীব্রতা অনুভব করতে করতে মনে হল
বহু লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের
কোনো মৃত নক্ষত্রের অচরিতার্থ কামনাবাসনা সেসব।
যে জ্বলনে সে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়েছে
লক্ষ লক্ষ বছর আগে ,
তারই যন্ত্রণা-তরঙ্গ রাস্তা ও ঠিকানা খুঁজে খুঁজে
কাল এসেছিল।
শ্মশানে এখন শুধু ক্যানভাসবিহীন নীরবতা ,
নির্বোধ ডাক্তারের স্টেথো এখনও ডায়াগনসিস খুঁজছে
সেই শ্মশানকে দেহ মনে করে ।
(১২)
বিষের আবেদন আমি ফেরাতে পারিনি ,
বারবার তাকে প্রবেশ করার ও অবস্থান করার
অনুমতি দিয়েছি আমার শরীরে ।
ঘন্টায় ঘন্টায় তাই উপলব্ধি করতে পেরেছি
বিষ কত দুর্বল , কত অসহায় , কত নিষ্ক্রিয় ।
গোখরো তাকে ধারণ করতে পারেনি
তীব্রতার অজুহাতে ,
জিভ পেতে আমি তার আস্বাদন নিই
বারবার। কৃতজ্ঞ বিষ
বিজ্ঞাপনের দায় বহন করায় না
আমার কণ্ঠকে ।
শুধু এক অদৃষ্ট ,অবিজ্ঞাপিত ব্ল্যাকহোল
অবিষাক্ত ,তুচ্ছ আমাকে আশ্রয় দিয়েছে ।
(১৩)
বৃহস্পতির সবচেয়ে ছোটো ,সাদামাটা ও অনুজ্জ্বল উপগ্রহে
নির্বাসন বেছে নিয়েছি আমি ।
তোমাদের বাড়ির কাছে কিছু রাস্তা আছে
যাদের যাত্রায় কোনো ঠিকানা নেই ,
কেবল আমার পায়ের ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে
ওদের শরীরে ।
লক্ষ লক্ষ বছরের কটু-দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে
যদি কোনোদিন তোমরা বৃহস্পতিতে যাও-ও
খুঁজে পাবে না আমাকে সেদিন।
(১৪)
সৌরজগৎ ছেড়ে প্রক্সিমা-জগতের দিকে
চলেছি তখন , সময় ভোরের দিকে ,
আরও যেন কেউ কেউ সমান্তরালে ,
কাছে দূরে ,সহযাত্রী । শূন্যপথে প্রাতঃভ্রমণে ।
তুমি এক কিশোরী-নক্ষত্র তখন।
আলোর সমস্ত প্রেম ছুটছে তোমার দিকে ,
আর এক নরম ,সবুজ জ্যোতি বার হচ্ছে
তোমার নিঃশ্বাসবায়ু পথে
বুকের গভীর থেকে ।
মহাশূন্যের সেই সহজভাবে বিছিয়ে দেওয়া
জটিল রহস্যকে
কাঁদতে শিখিয়েছিলাম সামান্য ,
সে প্রণবনাদ আজও ওম্ শব্দে অবাঙ্ রয়েছে ।
(১৫)
বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যাপী
চাষের জমি আমার ,
বীজের অভাবে ফাঁকা পড়ে আছে
কোটি কোটি কোটি বছর ধরে
এক কৃষ্ণতিল অভিমানের কূপে ।
নক্ষত্রলোকের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে
তাদের প্রত্যেককে ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
চুম্বনের স্বাদ নিতে নিতে উপলব্ধি করেছি
সৃষ্টির জ্বরে তারা বেহুঁশ হয়ে আছে
ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কেলভিন মাত্রায় ।
সুপারনোভার ডাস্টারে মুছতে দেব না
নক্ষত্রদের কোরাস,
তোমার শালিধানের বীজ ছড়িয়ে আসব সেখানে ।
(১৬)
নক্ষত্রলোকের ভাবনা নিয়ে
বসে আছি বাড়ির উঠোনে ।
এখানে , একএকটা গোলাপ গাছে
হাজার হাজার ফুল ফুটেছে ।
টেলিপোর্টেশনের সাহায্য নিয়ে
এই গোলাপ বাগানকে পাঠিয়ে দেব
সুপার গ্যালাক্সির গরীব সংসারে ।
বিশালতার অহংকারে দেমাকি অনন্তকে
'পুনরায় বিন্দু হও' মন্ত্রে
এখানে পাঠিয়ে দিও তুমি , একইভাবে।
এখানে এই বাড়ির উঠোনে তাকে
গাছের ছায়ায় রেখে দেব। বিনিময়ে
তোমাকে প্রেমের স্বাদে অধিকার দেব।
(১৭)
কণা , তরঙ্গ বা অজানা শক্তি
যা দিয়েই তৈরি হয়ে থাকি না কেন
তা খুব উচ্চমানের ছিল না ,
পরিমাণও ছিল না যথেষ্ট।
খুব ছোটো করে হলেও ,
আড়ম্বর যতই সামান্য হোক ,
একটা সুপারনোভা আসন্ন আমার ;
নেবুলা হয়ে থেকে যাব তারপর।
হে মহাবিশ্ব , জানি তোমার সঞ্চয়ও
খুবই সামান্য। তোমার বস্তু
সাকুল্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ ,
বাকি সবই অ্যান্টিম্যাটার।
কিছু অ্যান্টিম্যাটারই নাহয় ধার দাও আমাকে ,
আড়ালে আড়ালে টিকে থাকি আরও কিছুদিন।
অন্যবিশ্ব সন্ধানে এলে কোনোদিন
বস্তুর কয়েনে শুধে দেব ,
টেলিস্কোপের নামে শপথ আমার।
(১৮)
একটি বাইকের সামনে ও পিছনে
দুই যুবতীকে বসিয়ে
ছুটে গেল এক যুবক ,
খুব ভালো করে আমি লক্ষ করেছি
যে রাস্তায় সে ছুটে গিয়েছে
সে রাস্তা বৃত্তাকার।
একই সময়ে দূরবর্তী এক জ্যোতিষ্কলোকে
দুদিকে দুটো গ্রহকে নিয়ে
আহিরভৈরবী গাইছিল এক নক্ষত্র।
দূরে দূরে আরও কারা যেন
ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে।
আমাকেও ওদের মতো আবর্তন-নিষ্ঠ করে তোলো
হে শূন্য , হে নিষাদ।
(১৯)
কিছু একটা ভুলে যাবার আশঙ্কা
কাজ করছে মনের মধ্যে সবসময়ই
সামান্য দশ লক্ষ আলোকবর্ষ সময়ের পর
যে দুটো নক্ষত্রের দেখা করার কথা ছিল
সেই পুকুর ঘাটটির পাশে -
জল যার কণ্ঠলগ্ন ছিল হাজার বছর আগে ,
তারা যদি ভুলে যায় তাদের শপথ
কী হবে ? কিছু কি হবে ?
স্বাতীনক্ষত্রের এক বন্ধুকে আমি ভালোবেসেছিলাম ,
দুই বন্ধুর বাড়ির উঠোন ছিল পাশাপাশি ,
মাঝে সামান্য কয়েক ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পায়ের দূরত্ব মাত্র ,
সেখানে আমার যাতায়াত ছিল নিয়মিত।
কীভাবে যেন ভুলে গেছি ,
আশ্চর্য রকম এই ভুলে যাওয়া ।
(২০)
যে সময়ে রোবটের ,অ্যাপসের কবিতা লেখার কথা
পয়ার শিখতে এসেছি আমরা সেসময়ে ।
আমাদের ভূয়োদর্শী , প্রাগৈতিহাসিক শিক্ষকরা
অক্ষর নির্মাণের ক্লাস নিচ্ছেন
খুব মন দিয়ে ।
হে কণা কণা নক্ষত্র-কণার সংসার
তোমার যাবতীয় সুপারনোভা-জাত কবিতারা
ব্যাকরণের ভগ্ন-স্বাস্থ্যের কারণ হয়ে উঠছে ক্রমশ।
ছন্দ ,মাত্রা ,অন্তমিল নিয়ে কি তুমি ভাবছ না কিছুই ?
বিস্ফোরণ-বিস্ফোরণ খেলায় মগ্ন থাকবে কেবল ?
আর কিছুদিন সময় দাও হে নটরাজ ,
লালিত ললিত-জ্ঞানে ডুবে থাকি আরও কিছুদিন।
একান্তই ক্ষুৎকাতর হও যদি বাছা
আমাদের মস্তিষ্ক খেতে পারো ,
খেতে পারো আমাদের ইন্দ্রিয়সকল ,
মেরুদণ্ডের মজ্জা খেতে পারো ললিপপ করে ।
(২১)
যে নক্ষত্র কাছে ছিল এতদিন
সঙ্গে সঙ্গে ছিল ,
সে এখন বহুদূরে , অন্য ভুবনে ।
অন্য সেই পাড়া থেকে অন্য কোনো তারা
ডেকে নিয়ে গেছে তাকে ।
দূরত্ব যতটা এসে আমাদের মধ্যখানে জায়গা নিয়েছে
তৃষ্ণা ঠিক ততটা বেড়েছে ,
তৃষ্ণাকেই অভিকর্ষ বলে কেউ কেউ।
সে নক্ষত্রের পুকুরে ছিল জল ,
পানিফল ছিল ,
মাছের সাঁতার নিয়ে মণিবন্ধে নাড়ির স্পন্দন
সেই জ্যোতিষ্কের সঙ্গে সঙ্গে ছিল।
তুমি তারই স্তনপানে অনন্ত হয়েছ
হে শূন্য ,হে বিচিত্র নিষাদ।
(২২)
কণা-কণা যন্ত্রণা ছড়িয়ে আছে
অনন্ত মহাকাশ জুড়ে ,
সেসব যন্ত্রণা-দানা হু-হু জ্বলছে ,
তুষের আগুন হয়ে কেউ লাল ,কেউ নীল।
অপলক মাছের চোখ যেন।
এত এত যন্ত্রণা কার বুকে ছিল ?
সেই বুক ফেটে বুঝি ছড়িয়ে পড়েছে
থোকা-থোকা , দলা-দলা ,ছোপ-ছোপ যন্ত্রণার সুর।
দূরে , আরও দূরে দূরে
শরতের মেঘ যেন ছুটে যাচ্ছে অনির্দিষ্ট দিকে ।
কণা-কণা সৃষ্টির সব কণা ,কণা ,কণা
একটি কণার কাছে
অদৃশ্য হতে চায় বুঝি ।
(২৩)
জনসমক্ষে দুটো নক্ষত্র নষ্ট হতে চেয়েছিল একদিন
আমাদের জ্যোতিষ্ক সংসারে ,
ভালোবাসা তীব্র হলে এরকম হয় ।
আমাদের বাগানের কুল ও করমচা গাছের নিচে
এরকম ঘটনার অজস্র নজির
বারবার দেখা যায় বছর বছর ,
বর্ষার জল পেয়ে নষ্ট সেই ফলগুলো
প্রসব করে নতুন সন্তান , কে না জানে ।
নষ্ট হতে চাওয়া নক্ষত্রগুলো
নষ্ট হতে পারে না কিছুতেই , আরও
কত যে নক্ষত্র ,গ্রহ জন্ম নেয় নীহারিকা জুরে !
অক্লান্ত গণেশ বারবার লিখতে থাকে
মহাকাব্য , নতুন নতুন।
(২৪)
কোনো শক্তিই আর আমার উপর কাজ করছে না ।
ধুলো কণা যেরকম পরস্পর পরস্পরকে টানে
জোট বাঁধতে চায়
বাঁধে,
তারপর ঘুরে ঘুরে নক্ষত্রকে নাকাল করে , -
ভালোবাসা কী ভীষণ বস্তু , তার দংশন বোঝায় ;
তেমন জ্যোতিষ্ক-কাণ্ড ঘটে না আমার।
মহাকর্ষ , অভিকর্ষ - বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করে না এখন ,
অভিমুখহীন এক পতনের ভেসে থাকা আছে শুধু ।
মর্গের মৃতদেহ যেরকম থেকে যায় অর্থহীন
ব্যাকটেরিয়া না শনাক্ত করায় ।
(২৫)
ছায়াপথে অজস্র কোটির মাঝে
ওড়ে এক পাখি একা একা ,
জড় সংসারে তার অজড় হৃদয়
গানের শরীরে দেয় রঙ।
নক্ষত্রসমাজে ওঠে চাপা গুঞ্জন তাকে নিয়ে ,
তারা তাকে পেতে চায়
বিস্ফারিত হয় প্রত্যেকে,
তাদের বুকের টান
মাকড়সার জাল সৃষ্টি করে জ্যোতিষ্কলোকে ।
কীসের এ ছায়াপথ ?
এ-ই বুঝি মায়াপথ , অর্থহীন মায়ালোক ,
অনর্থক গূঢ় ভালোবাসা !
(২৬)
কত লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্ব ছিল কেউ জানে না ,
গণনা করেনি কেউ ,
একটি নক্ষত্র একদিন নিজেই
সে দূরত্ব মুছতে শুরু করে ব্ল্যাকবোর্ড থেকে ।
চাঁদকে সে শেখাতে এল
কীভাবে চাইতে হয় ,নিতে হয় , পেতে হয় ।
আর একটি নক্ষত্র ছিল আরও দূরে ,একদিন
শিক্ষাপ্রাপ্ত সেই চাঁদ তাকে পেতে চাইল।
দ্বিতীয় এই নক্ষত্রটি ছিল মৃত ,
মৃত নক্ষত্ররা দিতে জানে না , শুধু গ্রাস করতে জানে ।
দিগন্তহীন কালোশক্তির দুদিকে দুটি নক্ষত্র , জীবিত ও মৃত
মাঝে সেই অক্ষ-ভ্রষ্ট চাঁদ , -
মহাবিশ্বে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে কোথায় , হে জ্যোতির্বিদগণ
জানা আছে আপনাদের ?
অবিলম্বে চাঁদটিকে বাঁচানোর প্রয়োজন আছে ।
(২৭)
ফিউশন ভরা মহাকাশের নিচে
এই-আমির হিসাব শতাংশে কতটা জানি না ,
শুধু জানি
যে নক্ষত্রের ধুলোকণা থেকে আমার সৃষ্টি
তোমার লাবণ্যেও সেই একই পাউডার।
আলিঙ্গন এবং সংঘর্ষ যখন
পরস্পরের প্রতিশব্দ হয়
অঙ্কুরোদ্গমের গান বেজে ওঠে মাঠেঘাটে ,
নতুন সৃষ্টির স্বাদে গন্ধে
লীন হয়ে যায় স্রষ্টা।
পারলে এখনই একবার পুকুরঘাটে গিয়ে দেখ ,
জলে ভেসে উঠবে ঈশ্বরের মুখ।
(২৮)
যে নক্ষত্র জ্বলে ও জ্বালায়
পোড়ে ও পোড়ায়
ছাই করে সমুদ্রের নুন মাখা দেহ ,
তাকে আর পেক্ষাগৃহে আসন দেব না ।
যে নক্ষত্রের আলো
আমাকে আঁধার থেকে বিচ্যুত করে না ,
যে নক্ষত্র ক্রমে ক্রমে দূরবর্তী হয় ,
কৃষ্ণ-শক্তির কাছে করে আত্মসমর্পণ ,
তার জন্য বহুমূল্য প্রেম নষ্ট কোরো না হে বাউল।
বহু যত্নে , আয়াস করে , বিস্মৃতির সাধনা করো।
যখন সে মারা যাবে , নিশ্চিহ্ন হবে ,নিরাকার হবে ,
আমার বাগান থেকে একটি গোলাপ
নিয়ে যেও তার জন্য। দিও
স্মৃতিহীন ,ঘৃণা ভরা তার শবাধারে ।
(২৯)
এ নক্ষত্রলোক থেকে অজ্ঞাতবাসে যেতে চাই ,
আমাকে তোমার জঠরে জায়গা দাও হে কৃষ্ণগহ্বর ,
গোপনে লুকিয়ে রাখো আমি-হীন করে ।
তারাদের সব দেশ , সব ছায়াপথ , সব মাল্টিভার্স
বিষাক্ত হয়ে গেছে ;
তেজস্ক্রিয় উল্লাসে এরা মেতে আছে
অন্ধকার কুরুক্ষেত্র জুড়ে ।
সাদা ,বাদামি ,কালো বামনে ছেয়ে গেছে চরাচর।
এসব উচ্ছিষ্ট ,ছাইপাঁশ, পুরীষ তুমি খেও না ,
ভক্ষণ করো কেবল আমাকে ।
যত প্রেম আমি প্রেমকে দিয়েছি এতকাল বিনাশর্তে
সেসব তোমাকে আমি দেব ,
শ্বেত ,শুভ্র ,সুন্দর হয়ে উঠবে তুমি ।
(৩০)
তোমার বাড়ির পাশে
তোমার স্বপ্নদেখা-ঘরের কয়েক লক্ষ ট্রিলিয়ন
সামান্য আলোকবর্ষ দূরে
একটা পৃথিবী তৈরি করেছি আমি ,
সে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার নক্ষত্র
গোবেচারা চাঁদ হয়ে ঘুরছে দিনরাত ,
সামান্য প্রসাদের আশায় ।
তোমার বাড়ির পাশে
নতুন পৃথিবী আমি তৈরি করেছি ,
যার ভর তুমি , ব্যাস তুমি , পরিধিও তুমি ।
সে জগতে সুপারনোভা নেই ,
লাল কালো বামন নেই কোনো ,রাক্ষস নেই।
সেখানে কেবল এক পড়শি বাস করে
বন্ধুর অপেক্ষায় নম্র এক আলো হাতে নিয়ে ।
(৩১)
সৌরজগৎ আমাকে জানে না ,
জানে না আকাশগঙ্গা ছায়াপথ ,
পৃথিবীও ঘুণাক্ষরে ।
গ্যালাক্সির শেষপ্রান্তে
একা আমি বসে আছি ,
মন্দির চত্বরের স্পর্শসীমার বাইরে যেমন
গলাপচা কুষ্ঠরোগী ।
বহু রাস্তা ঘুরে ঘুরে
যেন কাউকে খুঁজতে খুঁজতে
চলে এসেছি এখানে ,
যাব আরও বহুদূরে
প্রক্সিমা ছড়িয়ে গ্যালাক্সি-মেলার মাঠে ,
কখনো আলোর রাজ্যে
অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে ।
ক্লান্তি ঝেড়ে ঘুরব এই
যাবতীয় বৃত্তাকার পথে ,যে বিস্ময়
হারিয়ে ফেলেছি একদিন যত্নের অভাবে
তাকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবো
কোয়ার্কমণ্ডলে ।
(৩২)
তোমার কাজের ব্যস্ততা নিয়ে
বহু নামী দামী পত্রপত্রিকায়
অনেক প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখা হচ্ছে ইদানিং ,
আমি তার দুএকটিতে
কর্নিয়ার ব্যবহার করেছি কৌতূহলে ।
এইযে ব্যস্ততা ভরা জীবন আমাদের ,
তা নিয়ে দুচারটি কথাবার্তা বলা প্রয়োজন।
সামান্য দূরে কোথাও
একটু নিভৃতিতে , চলো
কাইপার বেল্ট ছাড়িয়ে ঘুরে আসি ।
সেখানে একখণ্ড বরফের উপর বসে
আমাদের জীবন মেলে ধরি শূন্যের উপর ,
একদিকে নেপচুন
অন্যদিকে প্লুটোকে দেখতে পাব আমরা ।
অথবা সেখানে কোথাও নয় ,
আরও একটু দূরে কোথাও
একখণ্ড জমি খুঁজে আসতে পারি ।
অন্ধকারকে ব্যবহার করব অন্বেষণের কাজে ,
সেটা সে ব্রহ্মাণ্ডে অনেক এবং অফুরন্ত।
আমাদের জীবনও তো
খুব একটা ছোটো কিছু নয় ।
(৩৩)
ভালোবাসায় ভরে উঠেছিল প্রত্যেকটি অ্যালভিওলাই ,
আর ইতিহাস জানে
প্রেম হাইড্রোজেনের চেয়ে বহুগুণে হাল্কা ।
হাল্কা জিনিষের আয়তন বড় ,
তাই সে ভেসে থাকে ।
উক্ত বিজ্ঞানসম্মত কারণে
আকাশকে ছাড়িয়ে একটা লোক
মহাকে তুচ্ছ করে
মহত্তম টু দি পাওয়ার ইনফিনিটির দিকে
যাত্রা করেছিল।
অনন্ত তো জানে
প্রেমের মতো সীমাহীনতা তারও নেই ,
তাই একসময় সে
অ্যালভিওলাইগুলোকে বিস্ফোরণের ক্লাসে ডাকে ।
দিকদিগন্তে যে আমরা এত রঙ দেখি
এ-ই তার আসল কারণ।
(৩৪)
বৃহস্পতির শরীর থেকে
সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো ঝড়
এসে ঢুকেছিল কাল আমার ঘরে ,
আমার হৃদয় তখন সেখানে ছিল না বলে
হতাশ হয়ে সে ফিরে গেছে ।
আশঙ্কায় আছি , না জানি সে আজ
কার বুকে ফের হানা দেয় !
তুমি তো হৃদয় বলে কিছু
কখনোই রাখোনি কোনোদিন ,আর
তাই কিছু ভেঙে পড়বার ভয়
সেই বধ্যভূমিতে নেই আদৌ কখনো ।
শেষ হয়ে গেছে সূর্যের সামান্য জীবনের
পাঁচশো কোটি বছরের আয়ু ,
বাকি আছে আর মাত্র বছর পাঁচশো কোটি ,
চোখের পলকে তাও শেষ হয়ে যাবে অচিরেই।
তোমার অহংকার থেকে যে পুঁজ
মাটিতে গড়িয়ে পড়ে দিনরাত ,
ভেবেছ কি ,কে তাকে নির্বিষ করবে তখন ?
(৩৫)
নিজেকে তোমার সংসারেরই বলে
জানতাম এতদিন।
তোমার সঙ্গে বুধের ছিল
ঘনিষ্ঠতার নরম অহংকার ,
শ্রী ও সম্পদের দেমাক আছে পৃথিবীর ,
বৃহস্পতি ও শনির আছে
বিরাটত্বের আস্ফালন।
আমার এসব কিছু নেই , তবু
সকলের মতো সূর্যমুখী ছিলাম আমিও।
সামান্য হলেও অল্প কিছু
চাল ডাল আছে ঘরে , তাও
কেবল আগ্রাসী নই বলে ,
পরধন-লোভে মত্ত নই বলে ,
আজ আমি সংসার চ্যুত।
আমাকে বামন বলে লোকে ।
(৩৬)
এ মহাব্রহ্মাণ্ডে
শক্তি এক অদ্বিতীয় মাতব্বর ,
সে তার ইচ্ছায়
নক্ষত্রকে ভাঙে , গুঁড়োগুঁড়ো করে ,
দূরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় টুকরোগুলোকে ।
আকর্ষণ বজায় রেখে
প্রত্যাখ্যানের মর্জি অব্যাহত রাখে ।
কণাকে কণার জন্য অনিবার্য করে রেখে
উভয়ের বুকে পুরে দেয় ঘৃণা ।
জানালা জানে
কে ,কেন , কার জন্য তাকে খুলে রেখেছে ,
বাতাসে তবুও লেখা -
প্রবেশ নিষেধ।
(৩৭)
সবুজ আলো জ্বলছিল দুটো নক্ষত্রের গায়ে
একই সময়ে ,একই ছায়াপথে ।
আলোকতরঙ্গ যাওয়া আসা করছিল উভয়ের মধ্যে ,
খুব ব্যস্ততার সঙ্গে ।
হয়তো কিছু কথাও টাইপ হচ্ছিল
অ-অনুবাদযোগ্য এক শব্দের শরীরে ।
আমার ঘর থেকে একটি মাকড়সা
সম্পর্কের জাল বোনে মহাশূন্যে গিয়ে ,
একটি বাদামি নক্ষত্রও সেই জালে
অন্বিত হয়ে পড়ে নির্মমভাবে । কিন্তু
যেসব সংবাদপত্র ছাপা হয় জ্যোতিষ্কলোকে
তারা কেউ ওর কথা উল্লেখ করে না ।
(৩৮)
মহাবিশ্ব তার নিজের কথা
লিখে রাখতে চায় কিছুকিছু ,
তাই সে আমার আত্মাকে
মানচিত্রবিহীন এক নীহারিকা থেকে
প্ল্যানচেট করে ডেকে এনেছে
এই পৃথিবীতে ।
আমাকে মাধ্যম করে
সে তার নিজের কথা লেখে ।
দেওয়ালের গায়ে বারবার
প্রতিদিন নতুন নতুন
জানালা তৈরি করি আমি ।
ধুলোকণা , বালিকণা ভরা এই সৃষ্টির
রসহীন ঘটনার স্রোতে
ঘৃতকুমারীর রস মাখিয়ে চলেছি অবিরাম।
(৩৯)
আরও আরও দূর যাওয়া চাই ,
যতদূর যাওয়ার পর মনে হবে
নিজের সম্মুখে পৌঁছাতে
খুব বেশি দেরি নেই আর।
সামান্য কয়েক কোটি-কোটি জ্যোতির্বিদ্যা
একক দূরত্বের দূরত্বকে
গ্রাহ্যই করে না
আমার প্রেমের অন্বেষণ।
সে কেবল এইটুকু জানে
উপন্যাসে লেখকের হাতে
যে গল্প মূর্তি পায় ,
মহাসৃষ্টিতে কোনো অশোককাননে
সে নিশ্চয়ই অপেক্ষায় আছে
আমাকে অতুল করতে চেয়ে ।
(৪০)
বহু লক্ষ জ্যোতির্বিদ্যা-একক দূর থেকে
একটি অপরিচিত তারা ,
অন্য কারো সন্ধানে যে পথে বার হয়েছিল,
অকালবর্ষণে কাকভেজা হয়ে
আমার দরজায় কড়া নাড়ে।
আমি তাকে ঘরে ডেকে নিই , তাড়াতাড়ি
মাথা মুছবার জন্য গামছা হাতে দিই ,
শুকনো পোশাক দিয়ে পরে নিতে বলে
গরম চায়ের ঘ্রাণে আপ্যায়িত করি ।
বিপুল আলোর জ্বালা সমস্ত শরীরে তার
ক্ষতচিহ্ন হয়ে জ্বলছিল।
নিজস্ব সঞ্চয় থেকে কিছুটা অন্ধকার দিয়ে তার
শুশ্রুষা করি ।ঘামের নুনের স্বাদ চেটে নিতে বলি ।
আরও বহু লক্ষ জ্যোতির্বিদ্যা-একক দূরত্বে
সে তারাটি ফিরে যায় ভোররাতের দিকে ,
আঁধারের শুশ্রুষা পেয়ে
দেহে মনে একটু চাঙ্গা হলে ।
(৪১)
পৃথিবী-ঘরের দরজা পার হয়ে বাইরে আসি ,
শূন্য-পথে যাত্রা করি
আকাশগঙ্গায় স্নান করি ,
ছুটে যাই ভার্গোক্লাস্টারে , কুমারী কন্যার কাছে ।
তৃষ্ণার কাতরতা আমার দৌড়কে করে দ্রুততম ,
আলো তাকে ধরতে চেয়ে পিছুপিছু আসে ।
আউশ চাষের মাঠ ,বিশ্বাস রাখো ,সে কন্যাকে
তোমার উঠোনে এনে তুলব। বাসনায়
তোমার সংসার যেন ভরে ওঠে অরোরা-প্লাবনে ।
(৪২)
জীবনানন্দ দাশ আর আমি
এক গ্রহেই থাকতাম। লোকে বলে
সময়ের নাকি তিনটি ভাগ ; অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
অথচ সময় নিজেই বলে
সে এক মায়া ,এক বিভ্রম কেবল।
আরও বলে - জীবনানন্দ আর তুমি
এক গ্রহেই থাকো ,এক সৌরসংসারে ,এক গ্যালাক্সিতে ।
আমাদের স্থিতি যখন
এক ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথে ,খেয়ালের বশে
স্থান পরিবর্তন করে ,তখন
পুরনো সময় তার সঙ্গে যায় না ।
২২অক্টোবর ১৯৫৪ তে একদিন
এমন জায়গায় তিনি গেলেন একাকী
সময় সেখানে শূন্য। আর তাই
আজ বিকালে আমি যখন তার সঙ্গে চা খাব
দুজনের মাথার চুল আধাকাঁচা আধাপাকা।
একই নভোমণ্ডলের একই জাতীয় কিছু আয়ন
একই কবিতার হুবহু একই কিছু লাইন
দুজনকেই দেবে একসঙ্গে ।
(৪৩)
অনেক নক্ষত্রের মাঝে গিয়ে
বিশেষ নক্ষত্রটিকে ভুলে থাকতে চাই।
এই যে অন্তরীক্ষ ভরা আলো অন্ধকার ,
স্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা ভরা ,
অব্যবস্থা ভরা ব্যবস্থার আয়োজন ,
এই-আছে এই-নেই-এর
সরল অঙ্কের জটিল উপস্থাপনা, -
এরা সবাই খুব অবিশেষ।
হে বিশেষণ-প্রিয় তারকা বিশেষ
কত কোটি কোটি অবিশেষ-বিরাট আমার বন্ধু হয়েছে
ভেবো না, দেখো না।
আলোকে আঁধারের মতো নরম করতে
সচেষ্ট হও।
(৪৪)
একটি গ্রহই শুধু আমার দৃষ্টিকে
ব্রহ্মাণ্ড দেখার ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে ,
একটি গ্রহই।
আমি তার রূপে ,লাবণ্যে ,সুগন্ধে
ততটা মৌমাছি নই ,
আমার শরীরে ও ঘিলুতে যতটা অবশ আছি
বারংবার কোটি-কোটিবার তার
বর্ণালী মতিচ্ছন্ন দেখে ।
একটা কালো দৈত্যের মুখে
নিজেকে সে ছুঁড়ে দেয় বারবার ,
বারবার বার হয়ে আসে ফের
কোন অজানা সফেদ দ্বার দিয়ে ,
সব কালো ধুয়ে মুছে ।
গ্রহটির নাম ,পরিচয় ,পরিবার সম্পর্কে
আমি কিছুই জানি না ,
দেখি আর অনুভব করি
প্রেমের ভাইরাস খুব সক্রিয় হয়ে উঠছে
রসায়নাগারে ।
(৪৫)
অহংকার ছড়িয়ে রেখেছে কসমস ,
কোথাও পাথর ,কোথাও গ্যাস ,কোথাও বুদবুদ ;
কোথাওবা নিছকই পরিচয়বিহীন শূন্যতা ।
প্রেম নেই ,কাম নেই ,ঘাম নেই।
অনর্থক দেমাক তার ফুৎকারে উড়িয়ে
ফিরেছি তোমার এই জলের সংসারে ।
প্রজাপতি একদিন মৃদু নেড়েছিল তার ডানা,
বাতাসে সামান্য একটু কম্পন হয়েছিল বুঝি ;
সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড কাঁপছে সেই অভিঘাতে অবিরাম !
সে কখনো তোমার এই যাদুময় স্তন দেখেনি দুচোখে ,
কল্পনার কৌশলও শেখেনি কখনো ;
সে নেহাৎ সামান্য এক অতিদীন ব্রহ্মাণ্ড কেবল।
(৪৬)
দুটো শোবার ঘর
একটা বৈঠকখানা
একটা রান্নাঘর
অতিথিদের জন্য একটা ।
এছাড়া ঠাকুরঘর ,স্নানঘর ,
এককালে কেউ থাকতো
পুরনো ,ভাঙা ,বিষণ্ণ একটা কক্ষ , -
কিছুদিন আগেও যে ছিল
খুকির পুতুলঘর ,এখন ভাঁড়ার।
এই বাড়ি থেকে বার হলাম একদিন
যেখানে গেলাম
সেটাও একটা বাড়ি ,একইরকম।
সেখান থেকেও বার হয়ে অন্যত্র গেলাম ,
সেও অন্য আর একটা বাড়ি ; একই হুবহু ।
দুটো আয়না কি মুখোমুখি রেখেছে কেউ ?
ওই এক্সতম বাড়িটির
সদর দরজাতেও দেখতে পাচ্ছি
তোমার কপালের একইরকম উজ্জ্বল টিপ !
(৪৭)
তোমার ব্যর্থতা সম্পর্কে এজগৎ ওয়াকিবহাল নয় ।
তারা আলফাবিটা নিয়ে ব্যস্ত আছে ,
ম্যাটার আন্টিম্যাটার নিয়ে ,
ইউনিক ও মাল্টি নিয়ে তারা চিন্তিত।
শুকনো কাঠের দেহ
যত্ন করে খেত যে ঘুণপোকা
শীতের বাজার থেকে তারা এখন
ঘুমের পোশাক কিনেছে ,
প্লাজমা-রসে গান লিখতে চেয়েছিল যে লোকটা
তুষার চাদর হয়ে তাকে
ঢেকে ফেলল সেই ঘুণ-জনগণ।
তুমি নির্বিকার ,
এ তোমার ব্যর্থতা হতে পারে
পদার্থবিদ্যার সেরা গবেষণাগুলো
সে খবর রাখে না । আর তাই
তুমি বিষয়ক পদগুলোও
কবিতার লাইনে জায়গা পাচ্ছে না কোথাও।
(৪৮)
আমন্ত্রণ জানিয়েছি ,
না এসে পারবে না ।
আসার জন্য সৃষ্ট হবে ,
হবে নিজেনিজেই।
উপকরণ হিসাবে রয়েছে শূন্য।
আসবে ,জায়গা নেবে , থাকবে ।
জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে তারজন্য।
প্রসঙ্গ যেখানে নেই
সেখানেই তাকে খুঁজছি ।
নিজেই সে বাকদত্তা হবে খোঁজের কাছে ।
(৪৯)
এ বাড়ির ছাদে এক্স
ও বাড়ির ছাদে ওয়াই মুখোমুখি ,
মাঝে এক শূন্য-সিলিন্ডার।
ব্রহ্মস্বরূপ শব্দ যাতায়াত করছে
তার ভেতর দিয়ে ।
শব্দের শরীরে জলের পরিমাণ
বাতাসের পরিমাণ
সবসময় একরকম থাকে না ,
সে কারণেই আবহাওয়া নির্ণয়ের যন্ত্র ও
নির্দিষ্ট একটি দপ্তরের দরকার পড়ে ;
একজন আধিকারিক বসে থাকে সে দপ্তরে ।
ও বাড়ির ওয়াই , এ বাড়ির এক্স
সম্পর্শে এলেই হয় বিস্ফোরণ।
(৫০)
চুপিচুপি সে আসে ,
শব্দের অস্তিত্বকে কোনোরকম স্বীকৃতি না দিয়েই
চলে যায় ।
সে একজন চোর ,
অথচ কেউ তা জানে না ,
জানতে চাইবে না ,
মানবে না ।
বস্তু অবস্তু যেখানে যাকিছু থাকার
সবকিছু থেকে যায় ঠিকঠাক ,
চুরি যেতে চেয়ে যারা দীর্ঘকাল
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে
তারা শুধু জানে
সে কেবল সময়ের চোর।
(৫১)
ওহে কোয়ান্টাম-প্রেম
তোমার যাদুবিদ্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ
আমি বুঝে ফেলেছি
বুঝতে না চাওয়ার চেষ্টা দিয়ে ।
বেদনার প্রত্যেকটি দানাকে
একইরকমের করেও
সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা শরীর ও দেমাক দিয়েছ।
আশ্চর্যরকমের সব ম্যাজিককে
আশ্চর্য করে দিয়ে তারা
আমার অস্তিত্বকে ধরে ফেলেছে
অস্তিত্বহীনতার মধ্যে ।
আমার কোয়ান্টাম-প্রেমিকার
স্ফিতমান নাগালের মধ্যে
আমি এক কোয়ান্টাম-প্রেমিক।
(৫২)
আলাউদ্দিন পথের ডান বামের সব গলিপথগুলো
পরস্পরকে পরস্পরের মধ্যে খুঁজতে গিয়ে
এক তীব্র মিষ্টি জট পাকিয়ে বসে আছে ।
পৃথিবীর সেরা একদল বিজ্ঞানী
পথের সঙ্গে যাদের গলায় গলায় সখ্যতা
এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপের মুখে জানতে পারেন
মহাকাশের অসংখ্য সোলার-সিস্টেমে
এমন আলাউদ্দিন পথের সংখ্যা অগণন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের সব তৃষ্ণা যাকে খুঁজছে
সে কি এরকমই কোনো রাস্তায় হাঁটছে ?
জিজ্ঞাসার এই তীব্রতাকেই বলে প্রেম ,
যাকে তোমরা লম্পট বলে সন্দেহ করো অকারণ।
(৫৩)
কোনো একটি নক্ষত্রের
অসংখ্য-কোটি ধুলো কণার মধ্যে
একটি আমি আর অন্য একটি হস্তান্তর যোগ্য তুমি ,
এই সত্যটি কোনো সাধারণ সত্যের মতো
নিছক সত্য নয় ,
মিথ্যেকে তার অসত্যতার সত্যে
হারাতে পারে অনায়াসে ।
আমি যখন কন্যাকুমারিকার দিকে
শূন্য ভরে ভরে জায়গা তৈরি করতে করতে
তুমি তখন কাশ্মীরমুখী।
যে নক্ষত্রটি আমাদের জন্মের জন্য দায়ী
আমরাই যার অস্তিত্বকে বিপন্ন করেছি
সে কোনোদিন নিজেকে ফিরে পেতে চাইলে
উৎসে ফিরে যেতে হবে আমাদের,
বিলীন হওয়া আটকাবে না
ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট না থাকলে ।
(৫৪)
পরের বাড়ির শ্রী যাচ্ছে
আমার বিশ্রী বাড়ির সামনে দিয়ে ।
এতে ঈর্ষা করব , না কষ্ট পাবো ?
নাকি খুশি হবো ? নাকি
যা হবার তা এমনিই হবে ? জানি না ।
কণার কোয়ান্টাম তত্ত্ব
একজন নিরক্ষর মানুষ বোঝে না ,
অথচ তড়িৎ-আধানের
ইতি ও নেতিবাচকতা
তাকে সংক্রামিত করে ।
জড় ,অজড়ের যাওয়া আসা
অন্য কোনোভাবে সম্ভব হলে
হতভাগ্যদের দুঃস্থতা খানিকটা লাঘব হয় ।