অপেক্ষা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া
১)চলো আর একবার
চলো আর একবার শুরুতে ফিরে যাই।
শুরুর শুরুটা কেমন ছিল
মনে আছে নিশ্চয়ই ,
আমি তো স্পষ্ট মনে করতে পারি ,
বারংবার তীব্র হোঁচট।
কিছুদিন ভুলভ্রান্তি নিয়ে ঘর করা হল ,
তাতে হয়তো অধিকাংশ ইলেকট্রনই খরচ হয়েছে।
দুএকটি যা কানাকড়ি এখনও রয়েছে
চলো তাকে ফের অশেষ ভাবতে শুরু করি ,
চলো আর একবার , অসংখ্যবারের কথা
নাটকের অঙ্কে অঙ্কে বলি ।
ওস্তাদ ফতে আলি খাঁ সদলবলে যেভাবে জীবনকে বাজায় ,
আর একবার শীতের গাঁদা উচ্চারণ করি ।
২)ছাড়ো ওর কথা
ছাড়ো ওর কথা , ওকে ভুলে যাও।
ভুলে যাওয়াকে আর সম্ভাবনার অধীনে না রেখে
নিজের ইচ্ছেকেই তার দায়িত্ব নিতে বলো ,
ছাড়ো ওর কথা।
ওকে ওর পবিত্রতার নোট ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে
স্বর্গের জমি কিনতে দাও।
অনেক আলোকবর্ষ পথ
আমাদের অপবিত্র পায়ে পায়ে ধন্য হয়েছে ,
সেইসব পথ আজ
আমাদের জীবনের একমাত্র রাস্তাটি
বানানোর দায়িত্ব নিয়েছে ।
মাছের ভেড়ির পাশে
রাস্তা এক পাখির বিশ্বাস ,
পৃথিবীকে একমাত্র পৃথিবী বলে চিনতে পেরেছে ।
আমাদের সব সিঁড়ি উঠতে উঠতে
উল্টোদিকে বারবার মাটিতে নেমেছে ।
৩)পাশের বাড়ির ছেলেগুলো
পাশের বাড়ির ছেলেগুলো
তাদের অনেক অনেক টাকার পেট্রোল কেনা আছে,
দিনের মাথায় তারা বারবার
বাইকে স্টার্ট দেয় ।
ওদের বাইকের পিছনের সিটগুলো
চালকের দিকে ঝুঁকে থাকে ঝুঁকি নিয়ে , তাই
পিছনে যে ফলওয়ালাদের ওরা বসায়
তাদের ফলের ঝুড়ি ওদের স্পর্শ করে ।
বাইকে স্টার্ট দেওয়ার সেই বারংবার শব্দে
আমার ঘুম ভেঙে যায় , আর
প্রত্যেকটি ভাঙা ঘুমের ভেতর থেকে
বেলিফুলের গাছ বার হয়ে আসে হাসতে হাসতে ।
৪) সময় কাটাবার জন্য
সময় কাটাবার জন্য আমি পাঁকে নেমে পড়ি ,
নানা রঙ আর গন্ধের পাঁক
গোড়ালি ছেড়ে হাঁটু অব্দি ওঠে ।
হঠাৎ হঠাৎ পাশের বাড়িগুলোতে গেট খোলার শব্দ না হলে
পাঁক-সমাধিও হতে পারত আমার।
আদিত্য-এল-ওয়ান যখন পা গুনে গুনে সূর্যের দিকে যাচ্ছে
পৃথিবীতে তখন খানাখন্দ ,খালবিল ,কাঁচা নর্দমা কমে গেলেও
আধুনিক ডিভাইসগুলো সব পাঁকে ভরা ।
আমি সেসব ডিভাইসের সৌজন্যে
দিন দিন অপুষ্টির পুষ্টিতে পুষ্ট হয়ে উঠি ।
এইসব কথা জানবার শুনবার জন্য
পৃথিবীতে আর কোনো তুমি পড়ে নেই।
সময় কাটানোর কাটা-সময়গুলো
আমার বাড়ি ,রাস্তা আর শ্রীচৈতন্যে
ডাঁই হয়ে পড়ে আছে দুর্গন্ধে ভরা কুরুক্ষেত্রের মতো।
৫) আরও কিছুটা নষ্ট
আরও কিছুটা নষ্ট করে নিই নিজেকে ।
আদাজল খেয়ে যারা নেমে পড়ে বাথটবে
সাবানের ফেনায় নিজেকে নির্মল রাখবে বলে ,
আমি তাদের দলের কেউ নই।
এত যে মালিন্য সৃষ্টি হয়েছে মহাবিশ্বে
সে কি কেবল মলিনতার কথা বলার জন্য ?
সাদাকালোয় ভরা সংসারে
কাকে বেশি আদর করব ভেবে পাই না ।
নষ্টের মাহাত্ম্য আমি কী বলব কবি !
সে আমার বড়ো প্রিয়জন, কেবল আমার।
যে রাস্তা শাপদ খুব ,প্রচণ্ড ভয়াল ,
সে আমাকে কাছে পেলে
হয়তো গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাবে একদিন ,
হোক না তা সহস্র আলোকবর্ষ পর।
৬) অকথিত ,অশনাক্ত কিছু কথা
অকথিত ,অশনাক্ত কিছু কথা পথে চলেছিল ,
তাদের শরীরে ,চলায়, দৃষ্টিতে ভয় ছিল গাঢ় অ্যাক্রেলিকে
যেন তারা তাড়ায় তাড়িত হয়েছে
সমাজবিরোধী কোনো রাষ্ট্রের দ্বারা।
সেসব কথাকে কেউ শুনতে চায় না,
কণ্ঠে বা মনে বা শ্রুতিতে ধারণ করতে চায় না,
ভয় পায়।
কথারাও ভয়ে থাকে,
মানুষেও ভয়ে থাকে,
অরণ্যের উৎসর্জনে তারা আশ্রয় নেবে বলে
খুব দ্রুত হাঁটছিল।
আরও কত অশরীরী-কথা
ভ্রুণ-জন্মও পেল না, মারা গেল।
সেসব কথার জন্য
একজন সংগ্রাহক অত্যন্ত জরুরি।
৭)আমি সেদিন এক চার্চে
আমি সেদিন এক চার্চে গিয়েছিলাম ,
প্রার্থনার নির্দিষ্ট ঘরেও ঢুকেছিলাম।
সে ঘরে তখন মা মেরি আর যীশু
দুজনেই উপস্থিত ছিলেন।
প্রার্থনা জানানোর মতো আমার যে কিছু ছিল না
তেমন নয় ,
অথচ জানানো হল না ।
সে ঘরে তখন মেরি ,যীশু আর আমি
আর কেউ ছিল না ।
আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেককে দেখছিলাম ,
দেখতে চাইছিলাম।
সন্দেহ করছিলাম আর
সন্দেহ করতে করতে একটা মায়ার মধ্যে
জড়িয়ে পড়ছিলাম।
সে চার্চের প্রধান যাজক তখন
ফুলের বাগানে ঘুরছিলেন আর ফুল দেখছিলেন।
তিনি জানতেও পারলেন না
চার্চের মধ্যে তাঁর দুই আরাধ্য
একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কী কী কথা বলছিলেন।
৮) অপেক্ষা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া
অপেক্ষা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া ,
তার শরীর এক অদৃশ্য পৌনঃপুনিকতা দিয়ে তৈরি ।
হ্যাঁ নেই , নাও নেই -
কায়া নেই , ছায়া নেই -
সে এক অদ্ভুত রকমের তারযন্ত্রের সুর।
অথচ সেতার , সারেঙ্গি - এসবও
বলে না তাকে কেউ।
এত যে লোকের সঙ্গে আমার ওঠা-বসা ,
আলাপ-পরিচয় , বাদ-বিবাদ -
তারা কেউ তাকে আদৌ চেনে না ;
একমাত্র সময়ের সঙ্গে তার পানীয় ঘেঁষা সম্পর্ক।
তার জন্য একটা বড়ো আবাস বানাতে হবে ,
যাতে সে সছল-বছল করে শুতে বসতে পারে ।
এই সামান্য কয়েক কোটির গ্যালাক্সিতে
একটু অসুবিধাই হচ্ছে তার ,
উঠতে বসতে হাত পা ঠেকে যাচ্ছে দেওয়ালে ।
৯) পাথর কেটে বানিয়েছিল
পাথর কেটে বানিয়েছিল কেউ একটি মূর্তি ,
সে মূর্তিকে দেখার আগে থেকে,দেখার সময়কাল ও হারিয়ে ফেলার পরও কিছুদিন মিলিয়ে
একটা হাজার বছরের সময়কাল পেরিয়ে গেছে ।
এখন সে সংক্রান্ত কোনো কথা আর বাকি নেই।
পৃথিবীর সব রাস্তা পৃথিবী ছাড়িয়ে
বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে ,
সে পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি কোথায় পৌঁছাব
তা ভাবতে চাই না ,
কেবল হাঁটতে চাই আজ।
যদি কেউ সামনে থেকে ডাক দেয় ,
যদি বলে - এইখানে এসে খুঁজে নাও নিজেকে ,
আমি যাব সেই দিকে ।
গিয়ে যদি দেখি
সেও একটি পাথর কেবল , হতাশ হব না ;
অন্য কোনো রাস্তা খুঁজে নেব।
হয়তো পৃথিবীর অন্য সব পাথরেরাও
একদিন হাঁটতে বার হবে , যাদের সবাইকে
পাথর কেটে পাথর বানিয়েছিল কেউ।
১০)শীতের মরশুমে
শীতের মরশুমে গাঁদাগাছ জন্ম নিয়েছিল
তার নিজের তাগিদে ।
পুজোর ফুল যারা ফেলে দিয়ে যায়
বাসি হলে ,বাড়ির বাইরে ,ফাঁকা জায়গায়
নজরে আসেনি তাদের তাকে ,
উপেক্ষাই দস্তুর বলে নিশ্চয় ।
আমি ফুল কিনি না , পুজো করি না ,
বাগানও করি না কখনও।
কখনো সামান্য শ্রম দিতে হলে
সবজির বাগানে দিয়ে আসি ,
অন্ন ব্যঞ্জনের পাতে তারা
সেই শ্রম শোধ করে দেয় ।
সেই গাঁদা গাছ , ছোটো ছোটো
ফুলের কাহিনি গাইছিল ,নির্জনে ,
একা একা , সাধ্যমতো ।
উপযাচক আমি গিয়ে বলি - ওহে গাঁদা গাছ
সুন্দরী ,সুঠাম হওনি কেন তুমি -
কেয়ারি করা বাগানের অন্যদের মতো ?
পারোনি ফুটাতে ফুলও ঠিকমতো ।
উপেক্ষার গাঁদা গাছ
নীরবে উপেক্ষা করে আমার কথাকে।
১১)আমাকে যারা ভালোবাসেন
আমাকে যারা ভালোবাসেন তাদের জন্য
আমার আজকাল কষ্ট হয় খুব।
কেননা ,সঠিক পণ্য আমি কোনোদিন
সঠিক মূল্যে বিক্রয় করিনি তাদের।
পণ্যের ক্রোমোজোমে ক্রোমাটিডগুলো
প্লাস্টিক দিয়ে নিখুঁত তৈরি করে গুঁজে দিই।
এ পৃথিবী চিরকাল ,সরল মানুষ যারা তাদের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র তৈরি করে নতুন নতুন ,
আমাকে তাদের সামনে বন্ধু বলে পেশ করা
সেরকমই জঘন্য এক কাজ।
এ বছর বড়দিনে আমি সেই বন্ধুদের বালিশের পাশে
নতুন মোজার মধ্যে রেখে আসব
অতি মনোরম এক আত্মনিকেশের প্রার্থিত খবর।
যারা আমাকে বারবার অলৌকিকভাবে পুরস্কৃত করে
আল্লার দোহাই , ঈশ্বরে শপথ ,
তাদের পায়ের নিচ থেকে
টারসিয়ারি ,গন্ডোয়ানা চুরি করে নেব।
অবশ্যই সেইসব গুণমুগ্ধদের জন্য
চোখের কোণায় একটু চিকচিক করবে দুঃখবোধ।
১২)সকালেই পাড়ায় পাড়ায়
সকালেই পাড়ায় পাড়ায় চিৎকার করে
জানিয়ে গেল একদল ছেলে -
খিড়কি-জানালা বন্ধ রাখবেন ,
মৌচাক ভাঙা হবে ।
পাড়ায় পাঁচ শতাংশ লোকের
জানালা দরজা খোলা ছিল ,
তাদের মধ্যে কারো কারো ঘটনাচক্রে
বা আনুষ্ঠানিক কারণে ,
মাত্র দুএকজনের হাট করে খোলা থাকে
অকারণে ,সবসময় ।
যাদের দরজা জানালা কখনও খোলা হয় না
তারা মৌমাছি বা তার সঙ্গে সম্পর্কিত
কোনো বিষয়ে কিছুই জানে না ,
তারা কেবল প্রতিক্রিয়াহীন এক ঘুমের পাহাড়কে চেনে ।
মৌচাক ভাঙা মৌমাছিরা
দরজায় দরজায় এল আশ্রয়ের জন্য ,
কার্ডিয়াক-চর্চাহীন এ পাড়ায় কেউই
তাদের আমন্ত্রণ জানাল না চায়ের টেবিলে ।
১৩)নিজেকে অপ্রিয় করে
নিজেকে অপ্রিয় করে তোমাদের চোখে
দাঁড়িয়ে রয়েছি এই অনতিদূরেই ,
বুঝে নিতে চাইছি বন্ধু কীরকম লাগে এই খেলা ।
কতটা হাতুড়ি ঠিক সহ্য হয় আমাদের সামান্য প্রেমে ,
রোষের কামারশালে কতক্ষণ টিকতে পারে প্লাস্টিক-মন।
আমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে বেড়াই ,
দেখতে চাই অতিষ্ট হওয়া কত দ্রুত শিখে নিতে পারো।
এত এত রঙ আছে পৃথিবীতে
শুধুমাত্র সফেদ সাজ পছন্দ হয় না আর ,
কালোকেও একবার সাধ হয় আলিঙ্গন দিতে ।
আমার কর্কশবাক্যে নাইই যদি খুশি হও নাইই হবে ,
অখুশির বিভা লাগলে
তোমাদের জামার প্রিন্ট কীরকম হয় , জানা হবে ।
আমি যদি একবারও বিষদাঁত ব্যবহার করি , দেখা হবে
মৃত্যুর ঠুনকো ঘায়ে
তোমাদের অমিয়-রূপ কতটুকু টেকে ।
১৪)চলো সূর্যের সঙ্গে
চলো , সূর্যের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে আসি ।
অস্থির ভেতর যত জড়তা ,দুর্বলতা ,অভিমান সঞ্চিত হয়েছে ;
তার কাছে বিস্তারিত বলি সেইসব।
কতদূর যাওয়ার কথা ছিল আমাদের এই মানুষ-জীবনে,
কতটুকু যাওয়া হল ,
বাকি রয়ে গেল আরও কত বেশি ,
সেইসব নিয়ে সফেন আত্মস্মৃতি লিখে লাভ নেই।
চলো , তাকে সব খুলে বলি ।
সর্বাঙ্গ দিয়ে যদি তাকে করি আলিঙ্গন ,
সে তার উষ্ণতা দিয়ে আমাদের সব অপারগতা
ছাই করে দেবে ।
আর কোনো যন্ত্রণা , কোনো অনটন
আমাদের ভাঁড়ারের বাড়ন্ত সামর্থ্য নিয়ে
ব্যঙ্গ করতে সাহস পাবে না ।
চলো , সূর্য-সঙ্গমে কিছু রতি
যথাযথ ব্যবহার করি ।
১৫)ওহে নিশ্চয়তা ,আর কতদূরে
ওহে নিশ্চয়তা , আর কতদূরে তুমি ঘাপটি মেরে আছ ?
পৃথিবীর সব পথ হাঁটতে হাঁটতে শেষ হয়ে এল ,
ঠিকানা কি কোনোদিন পরিচিত হবে না আমার সঙ্গে
এ জীবনে ?
মধ্যাহ্নে ছাদের কার্নিশে বসে
বিজাতীয় পরিচয়হীন দুটো পাখি
পরস্পরের কথা নিজ নিজ বোধ দিয়ে বুঝে নিচ্ছে ঠিক ,
তাদের তো ধরা দাও তুমি সহজেই আপন গরজে।
ভাষা দিয়ে তৈরি হয় আমাদের যত ভালোবাসা ,
ভাষার অভাবে তারা মারা যায় ইতিহাস জুড়ে ।
এই নিয়তির অন্য কোনো অন্যথা হবে কি কখনো ,
নিশ্চিত বাড়ির খোঁজ আসবে কি আমাদের কাছে ?
১৬)তোমার সমস্ত কথা
তোমার সমস্ত কথা হানা দেয় আমার বাড়িতে ,
আমার উঠোনে যত গাঁদা কসমস - এই শীতে ,
তাদের পাপড়িতে লেগে থাকে ।
গরম কফির ছোঁয়া তোমার দৃষ্টি ছুঁয়ে ফিরে আসে বলে
আমার হরমোন-তন্ত্র রম্য হয়ে ওঠে ।
এই কথা জানা হয়ে গেছে বলে
অতিরিক্ত দেমাক দিয়ে নিজেকে অমিল করতে চাও।
তোমার কথারা কিন্তু ,যা যা তুমি বলেছিলে একসময় ,
জলের বিন্দুর মতো ভেসে ভেসে ফিরছে হাওয়ায় ;
তারা ওই দেমাকের কথা ভেবে নিরস্ত হয় না কখনও।
তোমার সমস্ত ঘ্রাণ লেবুর পাতার দেহে
যেন ক্ষীর , নাচে কাফি-স্বর হয়ে ।
তোমার সমস্ত ছায়া
উজ্জ্বল আলোয় ভরে থাকে ।
১৭) জানি এটা বিষ
জানি এটা বিষ ,
মুখে নিলে মৃত্যু অনিবার্য।
তবুও, সামান্য মৃত্যুর ভয়ে
বিষের মোহিনী-রূপ ,
মধু-স্বাদ
অস্বীকার করতে পারি না ।
জানি ঢি-ঢি হতে পারে ,
সমাজে ,সভায়
পদচ্যুতি হতে পারে
সংসারের দাক্ষিণ্য প্রাপ্তি থেকে ,
তবুও গহ্বরে ঝাঁপ
না দিয়ে পারি না ।
জানি ওটা শব্দভেদী ,
বুকে এসে বেঁধে ।
তবুও জলের সঙ্গে মিলনের কালে
শীৎকারের শিল্পরূপ
না এঁকে পারি না ।
১৮) এসেছিলাম তোমার কাছে
এসেছিলাম তোমার কাছে কথা বলতে ,
মুখোমুখি না হয়ে ফিরে গেলাম।
সাহস পেলাম না নিজের পায়ের কাছে ,
পেলাম না নিঃসন্দিগ্ধ বাতাস।
যে তুমিকে নির্মাণ করেছিলাম
শূন্যের উপর বাঁধা ভারায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ,
সে যে কেবল ইলিউশন ছিল
সময়ে বুঝিনি ।
এখন আমাকে সে কথা বলে বারবার
বিশ্বস্ত-পতন।
এসেছিলাম তোমার কাছে চিকিৎসার খোঁজে ,
অসুখের বিবরণ দিতে পারব না বুঝে
অস্তিত্বহীনতার কাছে ফিরে যাই।
১৯)যখন ঘুমাতে যাই
যখন ঘুমাতে যাই
জেগে থাকায় আক্রান্ত হই।
যেই বলি - জেগে থাকা এসো ,
রাজ্যের ঘুমের পাহাড়
গড়ে তোলে শীতল আন্টার্টিকা ।
এসব কথা আমি তোমাকে
বা কাউকে শোনাতে চাইনি ,
পৃথিবীতে আর কোনো
সুস্থ নাম বা সর্বনাম
আমার জন্য নেই।
প্রেম দিয়ে চকোলেট বানানো যায় না ,
এ বয়সে এসে নিশ্চিত জেনেছি ।
ঘৃণা দিয়ে যদি কিছু বানানো যায় ,
ভাবতেই ঘৃণার অভাব পড়ে যায় ।
চক্রান্ত শব্দটি বুঝি
নিজে নিজে সক্রিয় হয়ে উঠছে খুব
রক্তরসে ,হাড়ে ও মজ্জায় ।
২০) দুটো টিয়া পাখি
দুটো টিয়া পাখি এইমাত্র উড়ে গেল ,
একটা আগে আগে
অন্যটা ঠিক তার পিছু পিছু ,
মধ্যবর্তী দূরত্ব দু-ইঞ্চি ।
দুটো টিয়ারই ঠোঁট লাল ,
সবুজ পালকে ঢাকা শরীর।
ঠোঁটের সামনের অংশ থেকে
লেজের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত
দুজনেরই মাপ ছ'ইঞ্চি ।
ওদের দুজনেরই হরমোন ক্ষরণের সমস্যা
বা অস্ট্রোআর্থ্রাইটিস নেই ,
নেই ট্যাক্সরিটার্নের সমস্যা ।
এখনই আমি বেশ খানিকটা
আকাশ নিয়ে বসেছিলাম ,
তাতে শ'পাঁচেক ফুটবল খেলার মাঠ
হয়ে যেতে পারে ।
সেই আকাশ দিয়ে ওরা উড়ে গেল
পূর্ব থেকে অগ্নির দিকে ,
এর কোনো তাৎপর্য আছে কিনা
ওরা জানে না , ভাবে না ।
২১)একদিন কখনো সেখানে
একদিন কখনো সেখানে তুমি ছিলে ,
কখনো আমি ছিলাম ,
কখনো আমরা দুজনেই একসঙ্গে ।
আজ সে জায়গায়
আবার আমি গিয়েছিলাম
সবার অলক্ষে ।
গিয়ে দেখলাম -
আমি সেখানে নেই ,
তুমিও নেই।
এখন সেখানে অনেক নতুন মানুষ ,
আমার নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে একজন যুবক
তোমার নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে থাকা এক যুবতীকে
অপলক দেখছিল।
তার সেই দেখাটুকুতে
আর ওই যুবতীর ব্রীড়াটুকুতে
স্পষ্ট লেগে রয়েছে আমাদের গন্ধ।
এখনও সেখানে আমি আছি ,
এখনও সেখানে তুমি আছ ,
এখনও সেখানে আমরা গন্ধরাজ।
২২) সে যে আমার মধ্যেও ছিল
সে যে আমার মধ্যেও ছিল জানতুম না ।
'জানতুম' - এই পুরনো বাকরীতিটিকে একটি চুম্বন দিয়ে
ফিরে আসি তার প্রসঙ্গে ।
সে আমার মধ্যেও ছিল ? (!!!)
আমি কল্পিত-নিজ-কস্তুরীগন্ধে মগ্ন ছিলাম।
মাঝে মাঝে ঝাড়ু দেওয়া ,
লম্বা হাতে ঝুল ঝেড়ে নেওয়া ,
ফিনাইল-জলে ঘর ধোয়া মোছা প্রয়োজন,
- এসব জরুরি কথা বলেনি কখনো কেউ।
এজন্যই জীবনে একজন গুরু থাকা দরকার।
এখন তোমাকে লম্বা দেখলে ,
পাশের বাড়িতে আলো জ্বললে ,
তাদের মৎস্য চাষে লাভ হলে
আমার অম্লশূল বৃদ্ধি পায় ।
তোমার থুঁতনির তিলের শোভা দেখে টের পাচ্ছি
সে আমার ভেতরে আরও বেড়ে উঠছে ,
বলছে অবিরাম -
এ উঠোন ভালো নয় , ভালো নয় ,
নাচব না ।
'উঠোন'কে 'উঠুন' বললে কিছু দোষ হত ?
২৩)সুন্দরকে নির্মাণ করেছ
সুন্দরকে নির্মাণ করেছ
বেছে বেছে সেরা ,উজ্জ্বল ,বর্ণবহুল মিথ্যেগুলো দিয়ে ,
আমি তার পায়ের কাছে হাজির হয়েছি
নিঃস্ব হবার গৌরব অর্জন করতে চেয়ে ।
তুমি যে আমাকে অনুষ্ঠান কক্ষের শেষ আসনে বসিয়ে
বন্যার গান শুনিয়ে নির্বোধ বলে প্রতিপন্ন করেছ ,
সে কারণে তোমার ধন্যবাদ প্রাপ্য।
অথচ কোনো অস্তিত্বই আর আমার বাকি নেই
যা দিয়ে অকৃতজ্ঞতাও জানানো যায় । তাই
গানের বাণীতে যত মিথ্যা ছিল
সেসবের মধ্যে আমি রাস্তা হারিয়েছি ।
শহরের ঘরমুখো লোকেরা দেখতে দেখতে গেল
রাস্তার ধারে মাতালের মতো একটা মাতাল
ভেসে যাচ্ছে মধ্য রাতের দিকে , মাতাল হবে বলে ।
২৪)আগের লেখাটি শেষ না করেই
আগের লেখাটি শেষ না করেই এখানে এলাম।
এলাম বললে কিঞ্চিৎ মিথ্যা বলা হয় ,
আপাত উঁচু জায়গা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে এলাম
যাকে দেখতে পাইনি এমন কারো ধাক্কায় ।
তাকে রহস্য নামে ডাকে অনেকে ,
আমিও যদি তাই বলি ,ক্ষতি কী ?
অসহায় আমি তাকিয়ে আছি আর
আমারই প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে যাওয়ার দৃশ্য
আমারই চোখের মধ্যে ভিডিও রূপে আপলোড হচ্ছে ।
কাজের মেয়ে বাড়িতে আসে রোজ ,
ঝাঁট দেয় ,ধোয়-মোছে তন্নতন্ন করে ।
এত যে সময় পড়ে আছে ঘরেদোরে সমস্ত বাড়িতে ,
পচে নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ,
তা সে দেখতে পায় না , জানতে পারে না ।
ওকে যদি সেই কথা বলি ,
আদতে লেখাপড়া না-জানা মেয়েটি
যে দৃষ্টিতে তাকায় ,
তা দেখেই ভাষাবিদরা হতভম্ব শব্দটি খুঁজে পেয়েছিল।
সম্ভবত ওর মুখ থেকেই পাড়ার লোকে জেনেছে -
মাথা খারাপ হয়ে আমি এখন বদ্ধ উন্মাদ।
২৫)ওরা এখন প্রতিদিন বাড়ি বানাচ্ছে
ওরা এখন প্রতিদিন বাড়ি বানাচ্ছে
আমারই চোখের সামনে ।
( যে চোখ জোড়াকে আমার বলে দাবি করছি
সে বিষয়ে অবশ্যই আমি সংশয় মুক্ত নই।)
আলোর যেদিন বিশেষণ লাগে ঝলমল
সেদিনও বানাচ্ছে ,
আকাশ যেদিন মেঘের সঙ্গে ডিনারটেবিলে
সেদিনও সারাদিন।
ইটগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ,
ভারা বেঁধে লাগিয়ে দিচ্ছে সাতপাকের পলেস্তারা।
এই একই পৃথিবীতে
প্রতিদিন বাড়ি ভাঙছে আর একদল মানুষ ,
আমারই চোখের সামনে ।
ওহে ভাঙা গড়ায় ব্যস্ত পৃথিবী
ওদের শ্রম , ওদের প্রেম ,ওদের মায়া
কতদিন আর চুরি করবে তুমি ,
নষ্ট করবে এভাবে আর কতদিন ?
২৬)চশমাটা পাল্টে ফেলা খুব জরুরি
চশমাটা পাল্টে ফেলা খুব জরুরি হয়ে উঠছে ,
এতকাল যেসব প্রতিবিম্ব আমি আত্মস্থ করেছি
তারা কেউ আত্মস্থ করেনি আমাকে ।
আত্মচরিত লেখার প্রতিটি লাইনে
অসংখ্য 'হয়তো', 'যদি', 'সম্ভবত' ঘাপটি মেরে আছে ,
অসম্পূর্ণ ক্রিয়াপদগুলোকে কোনো সক্রিয় ক্রিয়াপদ
ফেলে দিয়ে গেছে স্তূপাকার।
যে কয়েকটি গাছ আমি লাগিয়েছি
পাঁজরের প্রত্যেকটি হাড়ের মজ্জার ভেতর
নিজস্ব মাটির জন্য তারা একে একে
ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীতে বসত গড়েছে ।
ফেলে যাওয়া সেই ফাঁকা বাড়ির স্মৃতিতে এখন
চিঠিপত্র অলীক হয়ে গেছে ।
নতুন চশমার দোকানে যাবার জন্য
রাস্তা তৈরি হচ্ছে ,
পিচ পড়ছে , পাথর পড়ছে নতুন বিশ্বাসে ।
২৭) আমি একশো শতাংশ নই
আমি একশো শতাংশ নই ,
হবও না কখনো ,
জানি ভালোমতো ।
এক শতাংশ হবারও কোনো
কথা তো ছিল না ,তাই
যেটুকু বাতাস এল দক্ষিণ থেকে
তাতেই বসন্ত উৎরে গেছে ।
গণিতের বিষয়ে যত অঙ্ক আছে
আমাদের পরীক্ষার ক্লাসে
তাতে যদি উত্তর না মেলে
হতাশার অবকাশ নেই , কেননা
জরিপবিহীন গানে
আমাদের পরিভ্রমণ।
২৮)ঘুমের মতো দুষ্প্রাপ্য
ঘুমের মতো দুষ্প্রাপ্য কিছু একটার নিচে
চাপা ছিলাম।
হঠাৎ কে যেন গ্রহান্তর থেকে
ডাক দিল।
শীতের লেপের মতো কবরের মাটি দুহাতে ঠেলে
উঠে এলাম ,
উঠে এসে দেখি কেউ নেই।
ব্যাটমিন্টনের নেট পৌষের মাঠের মাঝখানে চুপ,
শূন্যে উঠে মধ্যপথে দ্বিধাগ্রস্থ কর্ক।
ঘুম , ফিরে এসো । ঘুম , ফিরে এসো ।ফিরে এসো ঘুম।
আসে না ।
ঘুমের মতো দুষ্প্রাপ্য কারো ছবি
ডিজিটাল ক্যামেরার মস্তিষ্কে খুঁজি ।
২৯) অনেক বই আমি
অনেক বই আমি পড়তে পড়তে অসমাপ্ত রেখেছি ,
যে আমার প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে , সে ছাড়া
দেশের বাকি সব জনগণই জানে
পড়ুয়া হিসাবে আমার জি-আই-ট্যাগ নেই।
বইগুলোর অনেক পাতা আমি পড়েছি ,
লাইনগুলো পড়েছি বারবার ,
পড়েছি ব্যবহৃত শব্দগুলো ।
তাদের মিলন বিচ্ছেদও পড়েছি যত্ন করে ।
বই পড়ার সময় আমি দাঁড়ি কমা পড়ি ,
মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাগুলো পড়ি ,
আর বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ি
প্রত্যেকটি লাইনকে উল্টাদিক থেকে ।
একজন পাঠক হিসাবে আমার কোনো অভিজ্ঞান নেই ,
তবু এত এত বই যে আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম ,
দোকান থেকে ,বইমেলা থেকে তাদের কিনে আনলাম বয়ে বয়ে ,
তারা কেউ তো আমাকে পড়েনি একলাইন।
আমার বাড়ির নর্দমা ছাড়া আমার গোপন রক্তপাতের কথা
কোনো বই জানে না ঘুণাক্ষরেও।
বই আমাকে গ্রাহ্যই করেনি ।
৩০) পঙ্ক্তি কুড়িয়ে এনে
পঙ্ক্তি কুড়িয়ে এনে জড়ো করেছি প্রচুর।
মাঠে ময়দানে ছিল ,
রাস্তায় ছিল ,
অনেক পঙ্ক্তি পড়েছিল
বাজার উঠে যাবার পরের নিস্তব্ধতায় ।
অঙ্কের করাতে নির্দিষ্ট মাপে কাটিনি ,
ফাঁকা জায়গায় ভাঙা ইট মশলা মাখিয়ে গুঁজে দিইনি ,
ইমারত তৈরির শিক্ষা আমার নেই।
অনেক পঙ্ক্তি ভাঙা ছিল ,
পচা ,পোকালাগাও ছিল কিছু কিছু ,
অনেক পঙ্ক্তির গায়ে ছিল অবাঞ্ছিত দাগ ,ছিল
যে কথা সে বলতে চায়নি তার তকমাও।
আমি তাদের আদর করে তুলে এনেছি ,
তারা আমাকে আদর করছে সারাজীবন।
৩১) আজ সকালে কয়েকজন লোক
আজ সকালে কয়েকজন লোক বাজারে গেল ,
তারচেয়ে অনেক বেশি লোক গেল
হোমডেলিভারি করতে ।
কাজ বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু আমার নেই ,
আমি কেবল শহরময় ঘুরে ঘুরে
বন্ধ ইস্কুলগুলোর কান্না শুনে ফিরি ।
আজ সারাদিনে আপের পাঁচটা
ডাউনের তিনটে লোকালট্রেন
বাতিল হয়েছে ,ফলত
গেছে কম লোক ,ফিরেছে বেশি ।
কোথায় যেতে চেয়েছিল ওরা ?
মিছিলে লোক নেই ,ধর্ণায় আগুন নেই ,
অফিসগুলোতে দপ্তর নেই ;
শহরের মতো গ্রামগুলোতেও নেই মানুষ।
মন্দিরে আর দানসত্রে গিজগিজ করছে পোকা ।
আজ সকালে কয়েকজন লোক
নিজের কথা খুঁজতে গিয়ে
কোথায় যেন হারিয়ে গেল !
৩২)আমি আর একাকিত্ব
আমি আর একাকিত্ব
এক বাড়িতে আছি বহুকাল ,
পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসি
আলিঙ্গন করি
খুলে মেলে পড়ি ,
অথচ কেউ কারো মধ্যে
গর্ভসঞ্চার করিনি ।
মুখোমুখি বসলে
আমি কথা বলি বেশি ,
সে নীরব থাকে ।অথচ
বক্তব্য বিষয়ের সংখ্যার বিচারে
সে অনেক বেশি এবং অশেষ।
পাশাপাশি হাঁটলে
সে আমাকে সাহায্য করে ,
অভয় যুগিয়ে
দুঃস্বপ্নের ভয়কে বিশ্লেষণ করে ।
আমি মরে যাবার পরও সে থাকবে ,
আর আমি থাকব তার নীরব তীব্রতার ভেতরে ।
৩৩) অনেক পড়াশুনো করতে হবে আমাকে
অনেক পড়াশুনো করতে হবে আমাকে ,
অথচ পড়া হচ্ছে না কিছুই।
ছ'মাস আগে
পাঁচহাজার টাকার বই কিনে দিয়ে গেছেন এক বন্ধু ,
পড়া ধরবেন বলে শাসিয়েও গেছেন।
সেসব বই আমি হাতের কাছেই রেখেছি ,
শব্দগন্ধও নিচ্ছি নিয়মিত ,
কিন্তু এই উৎসর্গের পাতা ছাড়িয়ে
আর একটুও এগুতে পারছি না ।
এ বছরের ডিসেম্বর অতিক্রম করলেই
সম্পূর্ণ চৌষট্টি পার হয়ে যাব ,
অথচ সে চৌষট্টির একটির সম্পর্কেও আমি
কিছুই জানি না ।
পায়রা যখন তার গলার মধ্যে
হুঁউম হুঁউম শব্দ করে
তখন তার গ্রীবার পালকে আর চোখের পর্দায়
কতরকমের রঙ পরিবর্তন দেখা যায়
তার কিছুই জানি না ,
সময়ের অভাবে দেখা হয়নি ।
অত অত বই আমি পড়ব কখন ?
৩৪) এখন যে সময়গুলো
এখন যে সময়গুলো পার হচ্ছে
সেগুলো আর কখনও ফিরে পাওয়া যাবে না ।
এদের নিজস্ব কোনো পৃথক পৃথক পরচিতি নেই ,
আলাদা আলাদা নামপদও নেই।
ঘড়ির অঙ্ক দিয়ে চিহ্নিত করার একটা রেওয়াজ
চালু আছে সংসারে ,
সময়ের নিজস্ব কোনো দেহ নেই ,বাসভূমি নেই ,
প্রবহমান এক মায়া মাত্র।
আমার নিজের হাতে আঁকা পোট্রেটগুলো
বদলে নেওয়ার সুযোগ পাব না কখনও ,
অথচ প্রতিদিন কত কত মানুষের প্রতিকৃতি
এঁকে চলেছি নিজের খুশিমতো ,
বিন্দুমাত্র তাদের চেনাজানার চেষ্টা না করেই।
আমাদের এই এঁকে চলা যেন এক নিয়তি ।
সময়ের স্রোত পেরিয়ে যাচ্ছে ,
আমাকেও সে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে অন্যত্র।
দাঁড়াবার জন্য সরাইখানা নেই কোথাও।
৩৫) সাধনমার্গের লোক নই আমি
সাধনমার্গের লোক নই আমি , তাই
তাকে ছেড়ে তাঁকে দেখার ইচ্ছা পোষণ করিনি কখনো।
ইদানিং তবু মাঝেমাঝেই
ঘুমের মধ্যে ,চিন্তার মধ্যে ,অন্ধকারের মধ্যে
দেখতে পাই তাঁকেই ,
খুব রুষ্ট হয়ে যেন তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে ।
আজও পর্যন্ত কি তিনি জানতে পারেননি
আমি তাঁর রোষের পরওয়া করি না আদতে ?
আমি তাঁর তিনি হয়ে ওঠাকেও বিশ্বাস করি না ,
স্বীকার করি না , সমর্থন করি না ।
আমি তো কেবল তাকে দেখতে চাই অহর্নিশ
১৭বছর ১১ মাস একত্রিশ ডিসেম্বর যাকে দেখেছিলাম।
৩৬) সত্যের সম্পর্কে আমি
সত্যের সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানি না ,
দেখিনি কখনো তাকে সামনাসামনি ,
নাম ঠিকানার সন্ধানও জানি না ,
খোঁজও করিনি ।
পড়াশুনা করিনি সত্য সম্পর্কে ,
একটি কথাও লিখিনি কখনো তাকে নিয়ে ,
বক্তৃতা করিনি ।
এমনকি 'যাহা জানো বলো'তে নামও লেখাইনি ছাত্রজীবনে।
সত্য কি আমার সম্পর্কে কিছু জানে ?
আমার স্নায়ুতন্ত্রের কাজ ,হরমোন ক্ষরণের ধরন কিংবা
আমার সোডিয়াম পটাশিয়ামের মাত্রা সম্পর্কে ?
সম্ভবত জানে না কিছুই।
আমি কেবল একটা ভাঙা আয়না সম্পর্কে কিছু জানি ,
কারণ সে এই ঘর ,এই রাস্তা ,এই পাড়া ,এমনকি
আমার সম্পর্কেও অল্প অল্প করে কিছু জানে ।
সেইসব জানা এখনও ওর প্রত্যেকটি টুকরোতে
লেগে আছে কিছুটা কিছুটা ।
৩৭) একবার তাকে দেখা গিয়েছিল
একবার তাকে দেখা গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য ;
চতুর্দিকের ঘরবাড়ি ,বাগান-বারান্দা আর চোখের ভুরু
ঝলমলে বিশেষণটি পেয়েছিল।
কিন্তু মুহূর্তকাল পরেই সব আবার কেমন
আত্মসমর্পণ করল অতিঘুমের কাছে ।
একসময় বাগান জুড়ে পায়চারি করত যে গন্ধরাজ
আবার হয়তো সে বাকশক্তি ফিরে পেত ,
পাখিশাবকের স্বপ্ন জুড়ে থাকা উড়ালময় আকাশ
আমাদের আকাশের অভাব হয়তো মিটিয়ে দিত।
কিন্তু এসব শুভ সম্ভাবনা হয়তো কাউকে বিব্রত করছিল,
সাইক্লোনের মতো ফুঁ ব্যবহার করল সে ।
আলোর সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়ার ইতিহাস হয়তো কম ,
কিন্তু উজ্জ্বল।
সবুজ রঙে আঁকা বাগান আর
পর্যটন প্রিয় প্রজাপতিরা সবসময়ই আশাবাদী ,
মুহূর্তকে অনন্ত বানাতে তারা অত্যন্ত দড়।
৩৮) তোমার ভেতর দিয়েই ঢুকেছিলাম
তোমার ভেতর দিয়েই ঢুকেছিলাম,
অথচ জানতে পারনি তুমি ।
বড়ো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে
তোমার বাড়ির প্রধান দরজা ,
কখনো জেগে কখনো ঘুমিয়ে ।
সে দরজা পেরিয়েই ভেতরে গেলাম অনাহূত ,
সিঁড়ির ঘর পেরিয়ে
অতিথি আপ্যায়নের যে ঘর ,তার পারিপাট্য
স্পর্শ না করে
আরও একটু ভেতরে গেলাম চুপিচুপি,
ডানে বাঁয়ের ঘরগুলোতে উঁকি মারতে মারতে আরও একটু ।
জিরে পাঁচফোড়নের ঘর ঘুরে
আরো কত গ্যালাক্সি ভ্রমণের পর , না জেনেই
পৌঁছে গেলাম বাড়ির বাইরে যাবার রাস্তায় ।
তোমার সম্পর্কে কিছু বলব না ,
সব কথাই উৎকীর্ণ আছে জলের তরল শব্দে আর
মাটির আগামী অভিমানে ।
৩৯)তিনশো ষাট ডিগ্রিময় আমার দশদিকে
তিনশো ষাট ডিগ্রিময় আমার দশদিকে
আরও যত অসংখ্য দিক আছে
সবগুলো পায়ে পায়ে ঘুরে ঘুরে দেখি ,
কোথাও কোনো পথ নেই ,প্রতিশ্রুতি নেই।
নিজের ভেতর যত আনজন মানুষ রয়েছে
বহুকাল ধরে তারা পরিচিত হতে চাইছে আমার সঙ্গে ।
তাদের ভেতর যত রহস্য রয়েছে ,তারা প্রতিদিন
অতিক্রমের চেষ্টা অবিরাম রাখে
পরিখা ও অগ্নিবলয়ে ।
ঘুমকে বেষ্টন করে আমি দুরন্ত ছুটি ,
জাগরণকে বলি - ছুটে এসো ।
ছুটের ভেতর যত দ্বিধা থাকে ,দ্বন্দ্ব থাকে ,
ভয়ের মতোই কিছু অস্পষ্টতা থাকে ,
জ্যামিতির ক্লাসে তারা গোছা গোছা ভুল
আবিষ্কার করে বারবার।
৪০)এখন যেখানে তুমি বর্তমান
এখন যেখানে তুমি বর্তমান হয়ে বসে আছ
আমিও একদিন সেখানে ছিলাম।
শালের জঙ্গলের মাঝেমাঝে
আরও কিছু গাছ সেখানে ছিল ,
যাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্তরে আলাপ ছিল।
তাদের সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হত
সময়ের দেওয়ালে সেসব লিপিবদ্ধ আছে ।
সেই শালজঙ্গলের ভেতর আমার পদচারণা ছিল।
কত ভয় ,বিস্ময় ,সংশয় আর বড়ো বড়ো চোখের সঙ্গে
দেখা হত আমার মাঝেমাঝে ।
সরীসৃপের নিরীহ গমন থেকে একটা শব্দ
ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করত।
মাত্র একটা দশক এগিয়ে গিয়ে দেখো
তোমার বসার ওই জায়গাটায় কাকে দেখা যায় ,
যাদের সঙ্গে আজ তোমার শারীরিক ঘ্রাণ দেওয়া নেওয়ার মৌ
তারা তখন কোন সময়কে দিচ্ছে বর্তমানের পদবি ,
নিজের চোখে দেখে এসো একবার।
সময়ের সব কালখণ্ড একদিন দেখবে
ছবি আঁকার ক্লাস কীভাবে অখণ্ড হয়ে ওঠে ।
৪১)আমার চক্ষুজোড়ার কাজ
আমার চক্ষুজোড়ার কাজ আমি কমিয়ে দিয়েছি ।
ইদানিং ওরা বড়বেশি দেখছিল ,
শত নিষেধও শুনছিল না ।
যাকিছু দেখছিল তার পিছন ও সামনের দিকও
দেখে ফেলছিল তৎক্ষণাৎ এবং নির্ভুল।
অপটিকাল নার্ভের গোড়া কেটে দিয়েছি নিজের হাতে ,
বিম্ব প্রতিবিম্ব কিছুই আর দেখছি না বলে
শোনা ও বলার ইচ্ছেও এখন কমে গেছে ।
বইখাতা কাটার কাজে ইঁদুরের কোনো ব্যাঘাত হচ্ছে না আর ,
আমারও সময় কেটে যাচ্ছে মাখনের মতো ।
৪২)যদি আমার বাড়িতে আসতে চাও বন্ধু
যদি আমার বাড়িতে আসতে চাও বন্ধু
অনেক রাস্তার যেকোনো একটা
তোমাকে ধরতেই হবে ।
আমার বাড়িতে ঢোকার আগে
যে বাড়িটি অতিক্রম করতে হয়
সেখান থেকে রান্নার সুঘ্রাণ ভেসে আসে ,
আমার বাড়ির পরের বাড়িটি থেকে আসে অনেক জনরব।
আমার বাড়ির পূর্বদিকে আছে এক পাখিরালয় ,
পশ্চিমে কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন।
আমার বাড়ি চেনার আর একটি লক্ষণ বলে রাখি ,
আসতে সুবিধা হবে ,
আলো এখানে ছায়া নিয়ে গবেষণা করে অনুক্ষণ।
যদি আমার বাড়িতে আসতে চাও বন্ধু , এসো ।
আমি অবশ্য এ ঠিকানায় সর্বদা থাকি না ,
ঠিকানাকে দিতে চাই নতুন ঠিকানা ক্ষণে ক্ষণে ।
৪৩)এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে
এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে আমার, এমনকি
অসাফল্যের পরিচয়ও এখনো দিতে পারিনি তাদের।
পুরুষের স্পর্শ না পাওয়া কুমারী হয়ে তারা
রবহীন ,প্রাণহীন পড়ে আছে একপাশে স্তূপাকার।
মোরামের গায়ে লেগে থাকা লালমাটি
আলাদা করা হয়নি এখনও,
কুড়িয়ে পাওয়া নানান পাখির পালক
সংরক্ষণের জন্য করা হয়নি একটা যাদুঘর।
কয়েকহাজার টোল পড়া গাল
কীভাবে ভরাট হয়ে গেল জীবনের গ্লানিতে , লেখা হয়নি।
আরও কত কীই যে করা হয়নি জীবনে , ইয়ত্তা নেই।
বুকের ফোঁড়া ফেটে
যে রক্ত লেগেছিল গেঞ্জিতে ,ধোয়া হয়নি ।
কাজের চেয়ে অকাজের মূল্য যে অনেক বেশি ,
সে গবেষণা শুরুই করিনি এখনও।
৪৪)আকাদেমি বানান অভিধান
আকাদেমি বানান অভিধান
সর্বশেষ সংস্করণ ২০১১ , আমার সংগ্রহে আছে ।
কাজ এবং বয়সের চাপে
তার শরীরের বাঁধন একটু ঢিলে হয়েছিল।
আমার বড়ো সম্বন্ধী , অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায় ,একজন বই বিশারদ
বইটির নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন -
মেলানিন ও কোলাজেনের অভাবে
এটি অকালবার্ধক্যে আক্রান্ত।
ঘন করে ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করা আঠা দিয়ে
এটির চিকিৎসা সম্ভব ,
এবং তুমিই তা পারবে ।
কোনো কাজের জন্য আমার উপর কারো আস্থা রাখা
ভারতের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসে এই প্রথম।
সম্বন্ধীর লিখে দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী
বইটির শুশ্রুষার দায়িত্ব পালন করলাম।
কাজ শেষে স্পষ্ট অনুভব করছি
আমার দেহের অস্থিসন্ধির ব্যথা এবং
গলায় শ্লেষ্মাধিক্যের পরিমাণ অনেকটা কমেছে ।
৪৫) আসছ আর ঘুরছ ফিরছ
আসছ আর ঘুরছ ফিরছ। নিজের ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকা দেখছ।
প্রয়োজনে জল দিচ্ছ ,সার দিচ্ছ ,
দিতে দিতে কথা বলছ ,স্পর্শ দিচ্ছ ,চুম্বন ও আলিঙ্গন দিচ্ছ।
অদূরে ডলফিন-নোজ লাইট হাউসের উপর
নিত্যদিনের এক পর্যটক
স্বয়ং হয়ে উঠছে দূরবীক্ষণ যন্ত্র।
একই শহরের দুপ্রান্তে
এই দুটো ছোট্টো ঘটনা
ঘটে চলেছে প্রতিদিন ,প্রতিক্ষণে । কিন্তু
এ নিয়ে কোনো কথা বলে না কেউ ; -
সংবাদ মাধ্যম থেকে ব্যক্তিগত ফোনকলে,
জীবনের দিনলিপি থেকে অফিসের ফাইলে ,
গার্হস্থ্যের কড়চা থেকে সন্ন্যাসের নির্বাণে ।
এরপর একদিন নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় এক সমুদ্রে ,
আকাশে মেঘ জমে , বৃষ্টি হয় । আর তখন
পৃথিবীর সমস্ত গাছের পাতা থেকে জলের বিন্দু ঝুলতে থাকে ।
ওই দুটি নিত্য দৃশ্যের প্রতিবিম্ব
গাছেদের পাতায় পাতায় ,জলের ফোঁটায় ফোঁটায়
লক্ষাধিক ছবি হয়ে ওঠে ।
তখনও তুমি আসছ ,ঘুরছ ফিরছ ,
গোলাপ ও গাঁদার সঙ্গে গল্প করছ ,
তারপর ফিরে যাচ্ছ দৃষ্টির আড়ালে ।
৪৬) নিজের ভেতর থেকে বার হয়ে
নিজের ভেতর থেকে বার হয়ে রাস্তায় পা দিলাম
নিজের কাছে পৌঁছাবার উদ্দেশ্য নিয়ে ।
পথে অনেক ছোটো বড়ো ছায়া ফেললাম ,
বন্ধুত্ব পেলাম অনেক আশ্রয়ের।
হোঁচট খাওয়া ,পড়ে যাওয়া ,
কোথাও একবুক জলের সঙ্গে কিংবা
কোনো আহ্লাদিত লেলিহানের সঙ্গে দেখা হওয়া ,
এসব টুকটাক ঘটেছে পথিমধ্যে ।
রূপ বদল করে করে আসা হাওয়ারা ,
ঝুলতে ঝুলতে ঝুলবারান্দা থেকে ঝুলে পড়া স্বপ্নরা
উপন্যাসের দুএকটি করে পাতা ভরিয়েছে ।
তোমার ভেতর দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা দীর্ঘ রাস্তা
লেটারপ্রেসের কম্পোজিটারের মতো
খুঁটে খুঁটে চিনিয়েছে জীবনকে ।
এখন নিজের কাছে পৌঁছাবার আর বেশি দেরি নেই।
সেগুন গাছের পাতা ,বাজারের ভিড় আর তোমার চুলের ইশারা
সবগুলোই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে দ্রুত।
৪৭) ঘরের ভেতর খুব ঠাণ্ডা ছিল
ঘরের ভেতর খুব ঠাণ্ডা ছিল ,
প্রত্যেকটি বইয়ের পাতার ফাঁকে ফাঁকে
পুরু বরফ জমে গেছে ,
তাই বাইরে এলাম।
বাইরে এসে দেখি সেখানে
তাপমাত্রা হাজার ডিগ্রি কেলভিন,
অদৃশ্য কোনো অগ্নিকুণ্ড
হলকা ছড়িয়ে দিচ্ছে চতুর্দিকে ।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে , সবকিছুকে
ঝলসে খেতে সে খুব ভালোবাসে ।
বাধ্য হয়ে নিজের ভেতর ঢুকলাম ,
সেখানে তুমি ছাড়া আর
কখনো কিছু ছিল না ,
আজও নেই।
ভাঁজ করা একটা খাট ছিল
চৈতন্যের দেওয়ালে ,
সেটাকে ছড়িয়ে পেতে শুয়ে পড়লাম।
নিজের খোঁজ করতে গিয়ে দেখি
শীতের গাছগুলোতেও
ফুল ফুটেছে ঝাঁক ঝাঁক।