কিছু রতি ও কিছু ক্ষতি /দিশারী মুখোপাধ্যায় আংশিক




১)
মশা তার দংশনের নিষ্ঠা অক্ষুণ্ন রেখেছে 
বল্মীক সবকিছু মাটি করে দেয় আজও
শুধু মানুষ আজও দ্বিধায় আছে 
বয়স ও তারুণ্যের ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রায় 
প্রেম এবং উদাসীনতা 
কেউই বুঝে উঠতে পারেনি তাকে 

রাতের মধ্যখানে যে গভীরতাটুকুর গর্জন 
তার নৈঃশব্দ্য নিয়ে আমি বিপন্ন 

মেয়েটির ভেতরে একশো শতাংশ মেয়ে 
মেয়েটির ভেতরে একশো শতাংশ পাথর 
দুটো শব্দই ডাস্টারে মুছে যায় 


২)
কাদা জানে 
তাকে ছেঁকে তুলে নিয়েছে বলে 
আঙুলের কাছে কৃতজ্ঞ আছে স্বচ্ছতা 

বালির দানার আছে যে ভার 
স্রোতের একেবারে নিচে থেকে সে 
তরমুজকে তরজমা করে 

অন্য সকলের মতো কাদাও জানে 
জল  না থাকলে ঘড়ি চলত না, তবু 
আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে সংশয় 


৩)
আমাকে দেখলেই পংক্তি দূরে চলে যায় 

অনুমতি ছাড়াই যখন অভিমান সক্রিয় হয়ে ওঠে
নিম্নচাপ সৃষ্টি করে তরল পাষাণে 
তুফানের সামনে যার চ্যালেঞ্জ হওয়ার কথা 
সে তখন কোনো পংক্তিতে প্রথম আসনটির জন্য লোলুপ 

কেবল আমারই অযোগ্যতার কারণে 
রাত্রি তার যাবতীয় অলংকার হারায় কিস্কিন্ধ্যাপর্বতে 

একটি মথের রেণু মাখার স্বপ্নে জাগে প্রেম-উচ্চারণ 


৪)
হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে গেছে শিঙি 
যাবার সময় কাঁটা পরিপাটি 
এখন চোখের সামনে 
জলের সঙ্গে তার ঢলাঢলি

রোদের ঝকমকে চিঠি গাছের পাতায় ,আর 
সব উন্মুক্ত গোপনেরা 
পরস্পরের রূপ দেখে নিচ্ছে পরম আদরে 

সারা পৃথিবী থেকে প্রত্যাখ্যাত বঞ্চনা 
কেবল আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে 
আমি তাকে নিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে শুয়ে 


৫)
একটা পোড়া চিঠি পড়েছিল এখানে 
আগুনে পুড়েছিল 
সে আগুন কার ?

কিছু বাক্য ও অক্ষর আধপোড়া 
যারা পুরো ছাই হয়ে গেছে 
তাদের কথা জানা যাবে না 
ছাইয়ের ভাষা আর চিঠির ভাষা এক নয় 

পোড়া চিঠির পাশে আমি বসেছিলাম 
কয়েক জন্ম 
মাংস পোড়ার গন্ধ ছড়াচ্ছি এখন 


৬)
অর্থ নিয়ে অর্থহীনতার কোনো মাথাব্যথা নেই 

সাতদিনের যত্নে যে কুঁড়ি তৈরি 
আজ সকালে তার মাত্র দুএকটি বাক্য বিনিময় 
উষ্ণতা সৃষ্টি অসম্পূর্ণ রেখেই 
ঝরে পড়ার মেল রিসিভ করতে হয় তাকে 

ভাঙা পাথরের খাঁজে জন্মানো শ্যাওলাদের 
পিঠে থাকে না চাপিয়ে দেওয়া কোনো দায় 
তবু পাথরের রঙ ও কাঠিন্যের পরিবর্তন 

একটি অনিবার্য সংলাপের সন্ধানে 
সময় অনন্ত হয়ে প্রলম্বিত হয় 


৭)
তোমাদের ফেলে দেওয়া তৈজস 
চোখের জল গোপন করে 
প্রাচীনকালের যে রাস্তা 
পদচিহ্নের গৌরব হারিয়েছে 
তার ভাঙা ব্যালকনিকে সঙ্গ দিচ্ছিল 

বহু মানুষের ভিড়ে ক্লান্ত রাস্তায় আমি যাইনা
অগৌরবের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বাড়ে 

কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে চেনে না, তাই 
আমার রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করবে না কোনো ল্যাব 
কেবল বাতিল তৈজসের সঙ্গে চলে কথোপকথন


৮)
ভাঙা ইটের টুকরো 
অযত্নে পড়ে আছে বাড়ির বাইরে 
থানইটের ফাঁকফোকরেও তার জায়গা হয়নি 

অশনাক্ত একটি পাগল 
তারও কোনো জায়গা নেই, অপ্রয়োজনীয় 
টুকরো ইটের ভাঙা শরীরের রূপে মুগ্ধ 
দিনে দিনে তাদের মধ্যে ভাব জমে ওঠে 
বর্ষার জলে দুজনেই ভেজে, নরম হয় 
শ্যাওলা জন্মায় গায়ে 

এখন আয়নায় আমি দেখতে পাই না তামাম পৃথিবী 
ভাঙা রেক্ট্যাংগুলার আর পাগলের সজীব ভাস্কর্য কেবল  


৯)
এই গাছের ডালে একদিন এক পাখি এসে বসেছিল 
তার ডানায় অনেক সোনা ছিল 

গাছটার দিকে আমি অপলক 
উপরে আঁচলে নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে আকাশ 
নিচে মাটি কোলে নিয়ে জল 
গাছটাও আমার দিকে নির্নিমেষ

অদূরে ছোট ছোট আরও কিছু গাছ ছিল 
তারা আজ অনেক বড় হয়েছে, ব্যাপ্ত হয়েছে 
আমার গাছটা তাদের দিকেও তাকিয়ে থাকে 

অনেক অনেক পাখি আসবে একদিন 
অনেক অনেক সোনা 


১০)
চেয়ার ফাঁকা পেয়ে 
বসে পড়েছিল অবকাশ 

সে সময়েও আকাশে 
         কিছু রঙের ছোপ লেগেছিল 
দেখেনি কেউ 
উৎসের খোঁজ তো দূরের কথা 

মাটিতে, জলে, আগুনে যখন 
               অতিমারির আর্তনাদ ভরা
ফাঁকা চেয়ারের সংখ্যা বাড়ছিল 
অবকাশের গায়ে লেগেছিল ঘন অবসাদ 

আমার পুরোনো বাড়ির দেওয়ালে তখনো
রঙ লাগাচ্ছিল একটা অবুঝ রঙিন লোক 
কেউ তাকে দেখেইনি 
ডার্লিং বলা তো দূরের কথা

Popular posts from this blog

অপেক্ষা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া

স্বর ব্যঞ্জনের কথোপকথন

পাপের গুনাহ দেখি না