জীবন যেরকম ছিল
- Get link
- X
- Other Apps
১) মৃত্যু
এখন আমার সঙ্গে যেটা ঘটল, ডাক্তারি পরিভাষায় বলে
সোমাটিক মৃত্যু। এখনও আমার মস্তিষ্কের কোষগুলো
বেঁচে আছে। যদি জবানবন্দি নিতে পারো,এখনও কিছু সত্য
খুঁজে পাবে, যা এতদিনের সত্য সমূহের চেয়ে একটু বেশি।
ভর ও ভারহীনের রাজত্বে ঢুকে পড়েছি আমি।নিজের
ভেতর থেকে নিজেকে বার করে নিয়েছি।পড়ে আছে আমার
খোসা।খোলস ছাড়ার ব্যথা কিছু অনুভূত হবেই।কিন্তু
আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি, আমার ভেতরের হাজারো সাপ ,
আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।সাপেরা চলে গেলে আমি অভিশাপ মুক্ত।
কারণ, অকারণ যাই হোক, কেউ আর আমাকে বিব্রত করে না
বাড়ির কথা বলে; সব দরজা বন্ধ করেছি কিনা, তালাচাবি
দিয়েছি কিনা ভেতর বার । এখন কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না
দূরে ওই বাড়ির ছাদে, শীতের রোদে, কে মেলে বসেছে
তার চুল।কারণ এখন আমি আর কোনো তুমির জন্য কাঁদি না।
সব কান্না আমি উইল করে দিয়েছি তোমার নামে।
এখন আমার এই আমি-হীন শরীর খুব ঠাণ্ডা।কিন্তু সরীসৃপ নই।
২) মৃত্যুর আগে
বাড়ির চতুর্দিকের গাছেরা খুব নিজঝুম।যে অন্ধকার এবাড়ির
চতুর্দিকে ছিল আমার আশ্রয় হয়ে, আড়াল হয়ে, আরাম হয়ে, সে
আজ তার নিজের অন্ধকার রূপ দেখে বিমূঢ়।বুকের ভেতর থেকে
উপড়ে বার করে নেওয়া হয়েছে সেই বিষগাছকে, যার চুম্বন
বিছের মতো।বাড়ির ছোট্ট উঠোনটা আজ মহাকাশের অন্তহীনতাকে
চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, তাচ্ছিল্য করছে।
জীব আর জড়ের পার্থক্য জানতাম প্রচুর।জীবনকে দিয়েছি
প্রাপ্যের অধিক ভালোবাসা।জড়কে নিষ্প্রাণ বলে উপেক্ষা
করেছি প্রতিদিন।এখন আমি নিজেই জড়, নিজেই জীব।জীবন
আর মৃত্যুর অদৃশ্য পরিমাণ ফারাক এখন আর দুস্তর নেই।
জীবনের সব ভ্রান্তিগুলো উঠে বসেছে সত্যের জামা গায়ে দিয়ে।
পোষা বেড়াল কেঁদে বেড়াচ্ছে। সাধের কুকুরটা মন খারাপ করে
শুয়ে আছে।আমি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, টের পাচ্ছে না।পুবে
পুকুরের জলে ঝপাং করে একটা শব্দ হলো, শুনলো না কেউ।
৩) কোমা
এক নতুন ধরনের ঘুম আমার মধ্যে বিরাজ করছে।
এর জন্য
তোমরা বলছ আমি সংজ্ঞাহীন। ডাক্তারে একে বলছেন কোমা।
গুণে গুণে তিরিশদিন হয়ে গেল আমি এই স্বপ্ন-সুখের মধু
পান করছি।
গত আশি বছরের জীবনে আমার প্রাপ্তি ছিল কাটা ঘায়ে
আর একবার চাবুক।বিষণ্ণ আকাশের নামে ঢিঢি, আর
ক্যানভাসের উপর বাদুড় বিষয়ক প্রবন্ধের পণ্ডিতি।উত্তেজকের
অধীনে ছিল আমার স্নায়ুতন্ত্র।ময়ূরপুচ্ছের ঢলানি কিংবা
রামধনুর ভিবজিওর যুবতীর ঘাড়ে গলায় যতই খেলা দেখাক
আমাকে আর ফেলতে পারবে না মুগ্ধতার ফাঁদে।
তোমাদের যাকিছু সম্পদ আমাকে ভিখারী করেছিল আমারই
বুকের মধ্যে,চোখের কর্নিয়ায়,সেসব এখানে প্রচুর ,অগাধ,
অথৈ । এবং আমাকে পেতে চেয়ে তারাই ভিখারী।
অন্য এক ভুবনে রয়েছি এখন, অন্য এক ভবন।আমি, তুমি,
ওরা, তারা- কেউ নেই। অসংখ্য আর অসীমের শূন্যও
সামান্য হওয়ার ম্যাজিক কেবল।
৪) অচেতনের চেতন
রাত্রে ঘুমের মধ্যে ছিলাম।ঘুম আমাকে ছেড়ে ঘুরতে
গিয়েছিল কোথাও।প্রচুর জল ছুটে আসছিল আমার
বুকে। কে যেন তাদের আটকে রেখেছিল এতদিন।
পৃথিবীর সব জল আজ মুক্ত।আমাকে ভালোবাসবার
জন্য পাগল।জলের সঙ্গে আমি অভেদ হয়ে আছি।
আমিও জল।এবার ভাসিয়ে দেব পাথর-সন্ন্যাস।
দরজায় লোহার কড়াগুলো বরফের মতো গলে পড়ছে।
লোহার গায়ে লোহা লাগিয়ে যারা তস্করের থেকে
নিশ্চিত ছিল, তাদের সমস্ত প্রাসাদ উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে।
আমি দেখছি,তারা দেখতে পাচ্ছে না।ঘুম বুঝি তাদের কাছেই
গেছে ভালোবাসার মায়ারূপে।
আকাশের নক্ষত্ররা এসেছে দলবেঁধে।তারা আমার
দেখা পেতে চায়।কথা বলতে চায়।কেউ কেউ তো
আমার কাছে আলোও চাইতে এসেছে।আমি তাদের
কাউকে বিমুখ করব না।আমাকে পাওয়ার তৃপ্তিতে ওরা
উজ্জ্বলতর ক্রমশ।
৫) স্ট্রোক
গাছে তখনও পলাশ এবং গোলাপ দুজনেই ছিল।
সতিন-সতিন ভাব, সই-সই ভাব।অদূরে মহেশ্বর
ডমরু হাতে, গলায় বাসুকির সোহাগ।একটি সজীব
বাঘ সামনে হেঁটে যাচ্ছে তার সঙ্গে ,নগ্নতা আড়াল করে।
যত হাঁটছে, রাস্তা তত দীর্ঘ হচ্ছে।ক্লান্তি এসে সাহস দেখায়
চ্যালেঞ্জের।জটা ভারী হয়ে আসে।চাঁদের জ্যোৎস্না অসহ।
সম্পূর্ণ অচেনা এক মহেশ্বরের উপস্থিতি টের পায় দেবাদিদেব।
হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ করে, হাঁটা পথ ছোটো হয়ে আসছে
ক্রমশ, দুদিকের টান ছেড়ে দেওয়া ইলাস্টিকের মতো।
ছোটো হতে হতে সেটা তার পায়ের তালুতে ঢুকে গেল।
ব্ল্যাকহোল যেভাবে সব গিলে নেয় বলে শুনেছে সে।তবে কি
তারই পায়ের নিচে সেই কালো তিল?
অচৈতন্য মহাদেব পড়ে থাকে রাস্তায়।ত্রস্তপদে আসা একটি
অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আসে স্ট্রেচার।তুলে নেয়।
সাইরেন বাজিয়ে ছোটে হসপিটাল।স্টেথোবাদী ডাক্তারে
তাকে পরীক্ষা করে বলেন- স্ট্রোক।
৬) না-মানা হার
যারা এতকাল হাওয়ার অজুহাত দিয়েছে, দিয়েছে
দেওয়ালের অজুহাত,তারা কি এখন আর একবার
পাথরের গায়ে লাথি মারার ঝুঁকি নিতে পারে না ?
বৃদ্ধ হলেও লোকটা যে এখনও যুবক।এখনও সে
খুব সহজেই একটা অন্তহীন মাঠের হাওয়াকে তার
বাঁশির মধ্যে পুরে ফেলতে পারে।
বুকের ব্যথা হাঁটুতে নেমে এসেছে।রাতের অন্ধকার
ঘুমের অবসরে ঢুকে বসেছে চোখে।হেমলকের মায়া
আশ্রয় নিয়েছে রক্তে।
তবু লোকটা এখনও দেখে দুটো গাছের দুঃসাহসী প্রেম।
উৎসাহ দেয়।আষাঢ়ের বর্ষায় ক্ষীরের মতো স্বাদু হয়
মাটি। সবুজ ধান গাছের মাঠে কারা যেন লুকিয়ে লুকিয়ে
টিকিয়ে রাখে গান্ধর্ব প্রথা। মন্দ ভালোর দিকে, ভালোও মন্দের
দিকে, চুম্বক শব্দটির অদম্য প্রমাণ।
৭) বার্ধক্য
লোকটা একদিন একটা ডাক্তারের কাছে গেল।সে এমন
একজন ডাক্তার, যে নাক-কান-গলা, পাকস্থলী ও অন্ত্র, চোখের
ভেতর এবং বাইরে, কোমর-হাঁটু-গোড়ালি, কিডনি থেকে
ফুসফুস হয়ে হার্ট, সবকিছুতেই বিশেষজ্ঞ।রোগীর মাথার ভেতরেও
ঢুকতে পারে সে।মস্তিষ্কের লঘুগুরু জ্ঞান তার করায়ত্ত।
লোকটার সবকিছুই সে পরীক্ষা করে দেখল।দেখল
নিজের এবং ক্যামেরার চোখে।
কোথাও কোনো অসুখ ছিল না তার।সবই ছিল ঠিকঠাক।
তবে প্রত্যেকটা অঙ্গেরই এক্সপায়ারিডেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।
ডাক্তারবাবুরও কিছু ভুল হলো।হার্ট দেখল কিন্তু বুক দেখতে
ভুলে গেল।ব্রেন দেখল কিন্তু তার পলিস্তর সরিয়ে সরিয়ে
দেখল না।চোখ দেখল কিন্তু সেখানে মরা স্বপ্নগুলো নজরে এল না ।
রাস্তাগুলো বড় দীর্ঘ, একঘেয়ে এবং উঁচুনিচু হয়ে উঠল।দৃশ্যমান
সবকিছুর গায়ে পলিউশনের কালি।আহার্যের ভেতর এক গৈরিক
বিকর্ষণ।এখন কেউ তাকে দাদা, কাকু, মশাই, স্যার বলে না।
তার নাম ও সর্বনাম এখন একটাই, বুড়ো।
৮) অবসরের পরদিন
কাজের জীবন থেকে অবসৃত হওয়ার পর জানতে পারলাম
অকাজের গুরুত্ব কতটা আর কাজের জন্য আমি কতটা গুরুত্বহীন।
সকালের ন'টা-মণিকে আজ দেখলাম প্রথম।এই ছোট্ট ফুলটি যে
এই পরিণত বয়সে আমার শিক্ষক হতে পারে, তা নিয়ে কেউ
গবেষণা করবে না।অথচ এখন থেকে আমি জানতে পারব,
ছোট্ট ফুলটির বিভিন্ন ছায়া, কখন মাটিকে কোন পুরস্কারে
পুরস্কৃত করবে।
প্রতিদিনের যে ফেরি এ পাড়ার পাথর-বাতাসকে জলতরঙ্গের
ধ্বনি দিয়ে যায়, আমার শোনার সময় হয়নি বলে, জানতে
পারেনি কেউ।এ অপরাধ জীবনকে দরিদ্র করেছে কী ভীষণ!
আজই প্রথম টাইম-কলের জল এসে বলল- সহজপাঠের
প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগ তার নাভি থেকেই জন্মেছে।ওম্ ধ্বনির
চেয়েও মহার্ঘ এই বাণী শুনতে পাওয়ার পর, তথাগতের জন্য
করুণা হলো।বেচারা নির্বাণ পিপাসু !
৯) অবসর
চতুর্দিক থেকে সারাজীবনের অন্ধকারগুলো একজায়গায় জড়ো
হচ্ছিল । তারা ব্যথা ও যন্ত্রণায় পরিবর্তিত হচ্ছিল।বুকের
ফোঁড়া দুই হাঁটুর কাছে এসে টিসটিস করতে থাকল।
অতিপ্রাচীন এক আলোকবিন্দু আর ধ্রুবনক্ষত্র রইল না।
খসে পড়ছিল মৃত নক্ষত্র।
কখনো-কখনো গণিত তার নিজের নিয়মকেই মানতে চায় না।
সেজন্য সে প্রতিটি মানুষেরই জীবনের এক-একটা সময়কে
বেছে নেয়।তখন সেই মানুষটি বেভুল বলে চিহ্নিত হয়।
প্রতিটি পদক্ষেপ পড়তে শুরু করল গর্তের মধ্যে।যেটুকু
আলো তখনও জ্বলছিল, তারা আলোকিত থাকতে অনাগ্রহ
প্রকাশ করল।একদিন বিকালে, সারাদিনের হোঁচট আর
রিরাইটিংএর চেষ্টার পর, সহকর্মীরা তাকে বিদায় জানালো।
পরদিন থেকে ঘড়ির কাঁটা, বাস, ট্রেন ,- এরা কেউ ওর জন্য
অনিবার্য রইল না।একটা অনাত্মীয়তার স্বাদ তাকে বিস্বাদের দিকে নিল ।
১০) বিষাদ
অফিস ছেড়ে ছাদে উঠে আসতাম মাঝে মাঝে।পুরনো
দিনের লেজার, রেজিস্টার, বর্তমানের সিপিইউ, ইউপিএস
প্রত্যেকেই বড় দুর্বোধ্য আচরণ করত।বৃদ্ধ, ঢিমে মানুষকে
নিয়ে মানুষ যেভাবে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে শব্দবাক্য ছাড়া।
আলোর শরীর থেকে নুনছাল ছাড়িয়ে আবিল-হেঁয়ালি
মাখিয়ে দিলে অর্থের দুর্বোধ্যতা বাড়ে যেভাবে।
জন সমাগমের মাঝেই, দরজা-বন্ধ আলোচনায়, সিস্টেম ও
অনিয়মের প্রত্যেকটি আপডেটের সঙ্গেই কিছু নির্জনতা, কিছু
উদোম-সন্ন্যাস ও পিছিয়ে পড়ার হাতছানি নতুন নতুন
এররের মতো ঢুকে পড়ত।সেইসব ভ্রান্তিগুলোই অত্যন্ত সক্রিয়
হয়ে, কেবল আমাকে বুঝাতে চাইত, রামানুজন বা
চন্দ্রশেখরণ
গণিতে কতটা কাঁচা ছিলেন।
অত্যন্ত ছোটো ছোটো কিছু অঙ্ক, নোট অথবা সম্পর্ক ধরে
রাখার জায়গা হতো না কিলোবাইট, মেগাবাইট বা টেরাবাইটে।
ইরেজার ছাড়াই ডিলিট হতে শুরু করল অর্ধ শতাব্দীর সব
ইতিহাস।নির্জন টয়লেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকত আশ্রয়।
১১) যাপন
কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই ।কেননা
অভিযোগ শব্দটি বারবার আমার দিকেই ধাবিত হয়েছে ।
রাস্তার অসমতলতার জন্য কেন আমি দায়ী হব না ,সমুদ্র পৃষ্ঠে
নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার দায় আমার নয় কেন ,বাতাস
যখন ঝড়ের চেহারা নেয় এবং বালিয়াড়ি থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসে
অণু অণু আক্রমণ , সে দায় কে নেবে ,ইত্যাদি ।
আমি নীরবতাকে পোষ মানিয়েছি কুকুরের মতো ।নীরবে
সে আমাকে পাহারা দেয় ।একটি পেরেক কোথায় কোথায়
কতবার বিদ্ধ হতে পারে ,- গবেষণা করেছি গোপনে, এবং
লব্ধ তথ্যকে আমার ধী বাড়াতে কাজে লাগিয়েছি ।সেই ধী
কখনও নিজেকে ধীমান বলে দাবি করেনি ।
'আমি' - লোকটিকে হত্যা না করলে বাঁচানো যাবে না ,জানতাম ।
আজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি - আমাকে আত্মহত্যার দায়
থেকে বাঁচিয়েছে আমার চূর্ণিরা। বারবার তারা গুপ্ত ঘাতকের
ভূমিকায় অভিনয় করেছে দক্ষতার সঙ্গে ।
১২) উৎকণ্ঠা
অবিশ্বাস ,সন্দেহ আর দুর্বলতা দিয়ে ঘন করে
একটা গ্রেভি বানিয়েছি ।আগামীদিনে যে ঘটনা
ঘটবে ,যত শুভ্রতা ,সরলতা এসে তাদের নিবেদিতা
হতে চাওয়ার দাবি করবে ,সব এখানে ডুবিয়ে নেব।
বলিষ্ঠ ,পরিযায়ী পঙ্গপাল অথবা সবুজ,স্লিম গঙ্গাফড়িং
এই স্টিকি-গ্রেভিতে পড়ে নড়াচড়া করতে পারবে না ।
মধ্যরাতে বুকের বাঁদিকে একটু চাপ অনুভব করেছি ।তাকেও
উপহার দিয়েছি অবিশ্বাস ।ভূমিকম্পের কোনো নির্ধারিত সময়
জানা যায়নি ,হতে পারে যে কোনো সময়ে ।জলজ ভ্রান্তির নিচে
অভিমানের ক্ষীর জমা হয়েছে ।ভিক্ষা চায় হাতের তালুর ওষ্ঠ ।
কাল একটু বেশিমাত্রায় নিরপেক্ষ।এবং তার সময়-জ্ঞান বা
ঔচিত্যবোধ ,যা-ই বলো , খুব কম ।যখনতখন মেনসুইচ অফ
করে । এরকম অবিমৃষ্যকারীতা তার হামেশাই দেখি ।
১৩) অবিশ্বাস
বিশ্বাস আমার সঙ্গে একঘরে থাকতে আর রাজি নয় ।
চলে গেছে ।ধসপ্রবণ এলাকায় নিজেকে পুঁতে , হতে
চেয়েছি দেবদারু বৃক্ষ ।এবং যথারীতি অল্প সাদা ,
মোটামুটি সাদা আর অত্যন্ত সাদা, - সকলের জন্যই
বরাদ্দ করছি সমান সন্দেহ ।
আশ্চর্য হবার মতো অন্তত একটি শব্দ ডিক্সেনারিতে খুঁজেছি ।
পাইনি ।যেসমস্ত মনোরম ফুল যেসব লোকেদের বাগানবান
করে তোলে ,সেইসব ফুল ,সেইসব লোকেদের মতো পেতে চেয়ে
থাপ্পড় খেয়েছি ।আর থাপ্পড় এমন একটি জ্ঞান উন্মেষক
খাদ্য , যা খবর পর থেকেই দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর হয়ে ওঠে ।
স্পষ্ট দেখতে পাই সব ব্যক্তিগত চূর্ণিরা কীভাবে নদীর ভৌগোলিক
স্থিতিকে অমান্য করেছে ।
ধীরে ধীরে আমি খুব সহজ গণিতের মতো বুঝতে পারছি
প্রবীণতা আমার সঙ্গে করমর্দন করতে এগিয়ে আসছে ।
১৪) আতঙ্ক
বেশ কিছুদিন ধরেই কিছু একটা ঘটবে মনে হচ্ছে ।তবে
সেটা যে অঘটন হবে ,সে বিশ্বাস ক্রমশ মেরুদণ্ডের মধ্যে
অবাঞ্ছিত ফ্লুইডের মতো জমা হচ্ছে । মনে হচ্ছে কোথাও যেন
একটা ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখা আছে , তাকে তার নির্দিষ্ট
কর্তব্য বুঝিয়ে দিয়ে ।সে যেন ক্রমশ অধীর হয়ে উঠছে
তার দায়িত্ব করে ওঠার জন্য ।
বাজারে যাচ্ছি ,অফিসে যাচ্ছি ,পুরস্কার তিরস্কার প্রদানের
অনুষ্ঠানেও যাচ্ছি নিয়মিত ।সর্বত্রই কিছু ঘটার আশঙ্কা ।
জন্মের পর থেকে অনেকগুলো ক্যালেন্ডার জমা হয়ে গেছে ,তার
কোনোটাকেই তেমনভাবে কাজে লাগাতে পারিনি ।আদতে
কাজই আমাকে তার প্রয়োজনে লাগার যোগ্য বিবেচনা করেনি ।
বিষফোঁড়া যে গোদের উপরও হয় সে কথা অনেকেই জানে
এবং মানে।আমার বিগত যৌবনে মাটিচাপা উদ্দীপনা
মাঝেমাঝেই আমাকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে ।শয়তান এবং
ভগবান ,দুজনেই চেষ্টা করছে আমার দলে যোগ দিতে ।
কাকে নেব ?
১৫) বিগত যৌবন
পূর্ব আর পশ্চিমের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করছে ।কখনও
মনে হচ্ছে এখনও উদয়কাল ,কখনও মনে হচ্ছে অন্তের সময়
শুরু হয়েছে ।প্রজাপতির ফটো তোলে ,গল্পও করে কারো কারো
সঙ্গে ক্যানভাস নিয়ে ।আবার পিছন দরজা দিয়ে কার যেন লাশ
বার হয়ে যায় ।ফাঁকা চেয়ারটা কেউ তুলে নিলে , ওর চেয়ারটা
এমনিই এগিয়ে যায় ।
লোকটা রাগ পছন্দ করে । করতে ও করাতে।দেখতে ও দেখাতে।
তাতে নুন আর চিনির পরিমাণ ঠিক ঠিক থাকা চাই। গাফিলতি
সহ্য হয় না ।অথচ যতবারই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে ,ডাক্তার
তার প্রেস্কিপশনের মাথায় বয়স লিখে দেয়।প্রতিবার একটু একটু
বাড়িয়েও দেয় ।প্রিয় খাবারগুলো ছাঁটে।
এ মরশুমেও গোলাপ ভালো ফুটেছে ।লাল ছাড়াও সবুজ ,হলুদ
চকোলেটের সংযোজনও হয়েছে ।এবং কবিতা লেখা হয়েছে
অনেকগুলো । ৬৪ পাতার একটা বইও হয়ে গেল ।বইয়ের ক্রমিক
সংখ্যা ১২ । কীভাবে যেন প্রচ্ছদশিল্পীর তুলির আলো একটু
তেরছা হয়ে গেছে ।মানতে কষ্ট হচ্ছে ।
১৬) বেলা পড়ে আসছে
সহজ নির্ণয়ের কিছু ঘটনা অনির্ণীত হয়ে পড়ছিল ক্রমে ।লোকটা
তার কারণ বুঝতে পারছিল না। জলজ কিছু ছায়া তার মায়া কাটিয়ে
যেন বলতে চাইছে , এ জীবন অর্থহীন।কিছু গাছ প্রকাশ্য বাগানে
রাখা হয়েছে ।তারা ফুল ,ফল ,ছায়া সবই দেয় , কেবল রহস্য সৃষ্টি
করতে পারে না ।একটি গোপন বাগিচা ,প্রায় সকলের মতো ,তারও আছে ।
সেখানে ফুল ফোটে ,নষ্ট হয় ।ফল হয় নষ্ট হবার জন্যই ।
ছায়াও আপতিত হবার জায়গা না পেয়ে কেঁদে মরে।
অনেক ছোটো বড় নক্ষত্র খসে পড়ছে আকাশ থেকে ।কেন এমন হচ্ছে
বুঝতে পারে না ।এবং সেই মরা নক্ষত্ররা পড়তে পড়তে ইতিহাসের পাতা
বাড়িয়ে তুলছে ।
অথচ ,নদী এখনও জল দেয়, মাঝির সঙ্গে গল্প করে ,পরিযায়ীদের কাছে
তথ্য সংগ্রহ করে ।গর্ভের মধ্যে মাছেদের সংসার বাড়ে।বিরুৎজাতীয়
গাছেদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতায় ।
সপ্তাহে একদিন পরিপাটি করে চুলদাড়ি কাটে লোকটা ।সেলুনের
আয়নায় তাকিয়ে তাকিয়ে, পথচারী সুন্দরীদের প্রতিবিম্বগুলোকে
মার্কিং করে করে ,একটা কাল্পনিক তালিকা তৈরি করে আজও ।
১৭) স্মৃতি
জীবনে অনেক তুমি , অনেক সে ও অনেক তাদের সঙ্গে
নদী-প্রবাহের চুক্তি করেছি। তারা কেউই তাদের কথাগুলোকে
সাদা অক্ষরে ছাপায়নি ।কেউ কেউ অবশ্য অনাবিষ্কৃত ও
অব্যবহৃত ভাষাকে ব্যবহার করেছে আত্মগোপনের জন্য ।
আমিও নিজের স্বপ্ন-প্রণালী নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছি
বারবার ।কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়ে কিছু পেতে চাওয়াকে
নিরস্ত করিনি কখনও ।
প্রত্যেকটি ঘড়িতে এখন একটা স্থায়ী ভাটার প্রবণতা
দেখা যাচ্ছে ।অথচ আরব্ধ কাজ এখনও যে কতটা বাকি আছে
তা অজানা ।প্রত্যেকটি কাজ দাবি করে আমার শতকরা
পূর্ণতাটুকু ।প্রতারণা আমিও পছন্দ করি না ।যদি আরও
কোনো নতুন অতিথি আসতে বাকি থাকো ,বেলা পড়ে এলেও
স্বাগত জানাই ।
মোট যতজন তুমি ,সে ও তাদের নাম নথিভুক্ত হবে
প্রত্যেকের জন্য আমার আত্মজীবনীর একএকটি পাতা ধার্য হবে।
১৮) এক্সপেরিমেন্ট
আমি তখন বহু মানুষের আমিকে সংগ্রহে নেমেছি। গ্রামে ও শহরে ,
জলে ও জঙ্গলে, গ্রহে ও অন্য গ্রহে যাচ্ছি আসছি রোজ ।
লতার দৃঢ়তা ,বৃক্ষের নমনীয়তা স্পর্শ করতে করতে নিজের
আমিকে তৈরি করছি ।একটা বড় রাস্তার অনেকটাকে দেখিয়েছি
আমার পরিচয়পত্র ।তার আশেপাশে যে আরও বহু যদি ,কিন্তু ,
অথচ ,অথবা আছে ,তাদের সঙ্গেও দেওয়ানেওয়া করেছি
মিঠাপান।সেই বড় রাস্তার এখনও অনেকটাই , - বেশির ভাগটাই
বাকি । সঙ্গে সঙ্গে দেখা হবে আরও বহু ইশ্ , কী দারুণ , হায় হায় ,
ছিঃ ছিঃ , ইয়ে-হুই-না-বাত ,- এদের সঙ্গে । ওদের সঙ্গে আলাপ
পরিচয় হবে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে ,যাতে কেউ কারো ভাইরাসে
আক্রান্ত না হই ।
হঠাৎ একদিন , খণ্ড ত-টির উপর একটু বেশি মাত্রায় জোর
দেওয়ার মতো হঠাৎ করে তোমার সঙ্গে দেখা হলো। সেই দেখা
আমাদের পরস্পরের মধ্যে অনেকটা ভেতর অবধি পৌঁছে গেল
ক্রমে ক্রমে ।
সেদিনের কোনো কথাকেই আমি ইতিহাস হতে দিইনি। সবকটি
সংলাপ দিয়ে এখনও প্রতিদিন দিন শুরু করি ।
১৯) প্রবাহ
নেশা জিনিষটা কোনো একটা জায়গায় আটকে থাকে না ,
জল দেখলেই সে ঘাটের তোয়াক্কা না করেই সটান নেমে পড়ে ।
জলের আত্মপ্রকাশের রূপও সবসময় একরকম হয় না ।
তাই , লোকে যখন জলকে জল বলে চিনতে পারে না , একজন
নেশারত্ন-মানুষ কোনো ভুল করে না।ভুলের যাবতীয় সফট্-
অয়্যার বা হার্ড-অয়্যার একজন সঠিক মানুষের সামনে
নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ।
ঘাটে ঘাটে যায় ,যাত্রী নেয় ।তাদের সঙ্গে গল্পগাছা করতে করতে
জলকে ভাসিয়ে রাখার উপায় শেখায় ।এইভাবে কত মানুষ যে
কত মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ,সারাজীবনভর তার
ইয়ত্তা থাকে না ।
কবে , কার কার হাসি থেকে আমি অক্সিজেন পেয়েছি ,তা
জীবন কথায় লেখা যায় না । জীবনকথা কখনোই জীবনের মতো
সম্পূর্ণ নয় ,বিচিত্র নয় , সমৃদ্ধ নয় ।
২০) নেশা
কাঁচা সুপুরি খেলে নেশা হয় ,মাথা ঘোরে।যাদের রসায়নে
কৃত্রিম রাসায়নিক থাকে না ,খুব নরম হওয়ার দরুন, তারা
অচৈতন্য হয়ে পড়ে সাময়িক ।
একটা নিষ্কর্মা লোক ছিল একটি পাড়ায় । হয়তো থাকেও
প্রত্যেকটি পাড়াতেই একটি করে ।সারাদিন সে ঘুরে বেড়াত
সুপুরি বাগানে ।ব্যাগ ভর্তি করে সুপুরি কুড়াত।কাঁচা সুপুরির
নেশায় লোকটা পাগল হয়ে গেল । বাহ্যচেতন বলে কিছু
রইল না তার ।মেজাজের অচৈতন্য-মেজাজ জাঁকিয়ে বসল ।
লোকে অবশ্য বলে সুপুরি আর আফিম এক নয় ।
প্রত্যেক বাড়িতে একজন করে দোকানদার থাকে ।সেরকম কেউ
একজন সেই সুপুরি সেদ্ধ করে ,শুকিয়ে ,কেটে বাজারে বিক্রি করল ।
পানের দোকানে তার বেশ কদর ।ভাজাসুপুরিও খায় কেউ কেউ ।
ডাক্তাররা ইদানিং বলছেন - সুপুরি খেলে ক্যান্সার হয় ।
২১) সময়ের অবৈধতা
আধো শোয়া ,আধো বসা, সেদিনের-তুমি জানালায়। স্বয়ং জানালাও
অভিপ্রায় বুঝতে পারেনি ।যেসমস্ত শাল,শিশু , সেগুনেরা ছিল অদূরে
সারিবদ্ধ ,তারা যেন কোনো ঘোষণাবিহীন নির্দেশ পেয়েছিল । কেউ
হয়তো সেদিন রাস্তাকে বুঝাতে আসবে - কেন তার একটু পরিবর্তন
দরকার। অন্তত একটা বাক সেদিন খুব প্রয়োজন ছিল ।
কোথাও একটা ছেলের ঘুড়ি কেটে গিয়েছিল ,তার লাটাইয়ের
সুতো থেকে।কেউ কি কেটেছিল আড়াল থেকে ? নাকি সুতোর
ক্ষমতা তেমন পক্ক ছিল না ? হাওয়াতে সেসব ভিডিও-রেকর্ডিং
করা আছে নিশ্চয়ই ।কোথায় গিয়ে পড়েছিল সে ঘুড়ি ,তাও।
দাবার বোর্ডে ,দুই রাজাই যদি একই মাঠে এসে পড়ে ,খেলার
ভবিষ্যৎ কেমন হবে জানতে না ।দুই রাজাকেই একই ডিনারটেবিলে
আমন্ত্রণ করলে একসঙ্গে ।সে কথা অবশ্য কোনো পাখিও জানতে
বা রটাতে পারেনি। সূর্য তখন দুপুর বারোটা অতিক্রম করেছে
পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে ।
২২) জীবন
একদিন কথা বলার তাগিদ অনুভব করলাম । শুধুমাত্র
ইট নয় , বালি-সিমেন্ট-পাথরও লাগে ।কম করে একজন
মিস্ত্রি লাগে।অনেকটা করে ফাঁকা জায়গা লাগে।গল্প
রাখার জন্য ফাঁকা জায়গা অনিবার্য । দুএকজন কমবয়সী
মেয়েও লাগে গাঁথনির কাজে। কারণ গাঁথনির মশলা খুব
মজবুত হতে সাহায্য করে সেই মেয়েদের হাতের স্পর্শ ,
হাসির শব্দ আর চোখের ইশারা ।
অনেকগুলো গল্প বলে গেলাম সংসারের জন্য । যখন
যেখানে যতটুকু প্রয়োজনে লাগবে ভেবে। অবশ্য কোনোটাই
সম্পূর্ণ বলিনি।সম্পূর্ণ গল্প মানুষ হজম করতে পারে না ।গল্প
নিজেও কিছু কিছু অতিরিক্ত কথা বলেছে ।কেন , তা আমি
বলতে পারব না ।
নটে , পুনকো ,শুশুনি ,হেলেঞ্চাদের কথা বলার ফাঁকে
লেটুস , পালঙ,গিমের কথাও এসেছে আলাপ পরিচয়ের মধ্যে ।
২৩) অনুসন্ধান
শব্দ নিয়ে খেলা চলছিল তখন। দুমড়ানো, মুচড়ানো,
ভাঙা। গাঁথনির সময় ছোটো ছোটো ফাঁকফোঁকরে শব্দকে
ভেঙে ভেঙে ঢোকাতে হয়।কেবল বর্গাকার বা আয়তাকার
নয় ,সবরকম ভুজকেই তখন নিতে হচ্ছিল ।তারা যে যেমন
করে শুতে, বসতে, খেতে, পান করতে চেয়েছে , দিতে হয়েছে।
আমিষ ,নিরামিষ ,সবরকমের জগতের জন্যই একটা
বড় কার্পেট দিতে হয়েছে ।অস্থিসন্ধির ব্যথার জন্য সবাই
পা ভাঁজ করতে পারে না।উঁচু আসনের ব্যবস্থাও রাখতে হয়েছে।
সমুদ্র তখনও আবিষ্কার করেনি তাকে।দীঘি, পুকুর, খাল-
বিলরাই তাকে স্নান দিত সামর্থ্য মতো।জল আর মাছ আর
জলজ উদ্ভিদের কথা ছড়িয়ে ছিল দুনিয়ায়।সেই ছোট্ট দুনিয়া
ভেতরে ভেতরে বেড়ে উঠছিল রোজ ।
বেশ নতুন কিছু শব্দ সংগ্রহ করল লোকটা সেই সমুদ্রের
শরীর থেকে।সমুদ্রের ভাঁজে ভাঁজে অজস্র নতুন নতুন শব্দ
প্রবাল বিষয়ক কথায় এসে পড়ে ।
২৪) সীতাহরণ
একটা পুকুরের পাশে আরও একটা পুকুর শুয়ে থাকে ।
পুকুর দুটো যে দুটো , একটা নয় , সেটা বোঝার জন্য
একটা আরোপিত বাঁধ ছিল । তাকে বর্ডার বলতে পারো ।
দেখা না গেলেও ,অনুভব জানত ,সেখানে একটা কাঁটাতারের
বেড়া আছে ।তার চোখে একটা বড় ,একটা ছোটো। বড়টা
কখনও ছোটো, আর ছোটোটা কখনও বড় ।একটা পুকুর
কখনও পুরুষ ,অন্যটা তখন নারী ।অবশ্য তাদের কোনো
যৌন অঙ্গ নেই ।তবু রমন রয়েছে পুরোমাত্রায়। ভালোবাসা
ওদের দুজনকেই ভালোবাসে ,কাঁটা উপেক্ষা করে ।
কেউ বা কয়েকজন একদিন একটা পুকুরকে তুলে নিয়ে গেল ।
পাচার করে দিল ।পাচারের সময় প্রজাপতি ঋষির স্তুতি
হয়েছিল।ঘি পুড়েছিল কয়েক মন।অন্য পুকুরটা তার অভাবে
শুকিয়ে গেল।যেন পাতালে কোথায় ফাঁকা খনি-গর্ভ আছে ।
জল যেন ষড়ে পা বাড়িয়েছে ।
পুকুরদুটোর আর কখনও দেখা হয়নি ।এমনকি এখন
শালুক আর পানিফলেরাও জানে না পুকুর কাকে বলে ।
২৫) প্রেম
তারপর জীবনে একটা সময় এলো ।কর্মবীর পুরুষদের
জীবনীগুলো আর মমতাময়ী মায়েদের স্পর্শগুলো বলতো
কাজ করতে হবে ,লীন হতে হবে । অথচ হৃদয় কথিত
মস্তিষ্কের মধ্যে একজাতীয় পোকা লাগতো ,যারা মনের
ভালোলাগাকে কেটে কেটে নষ্ট করত।কিছু আঁচলের ডানা
কিছু ফ্রকের ঘূর্ণন গার্ডেনিং করার প্রেরণা দিলেও তা
বেশিক্ষণ টিকত না
জ্যমিতিবক্স ভেঙে টুকরো টুকরো করতাম ।স্বপ্নে যাকে
কাঁদতে দেখতাম ,বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হতো, কাঁদে আমার জন্য ।
আদতে তার শরীরী রেখাগুলো আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধাচরণ
করত সবসময়।
একদিন এক আত্মহত্যার বীজ থেকে আবিষ্কার করলাম
একটা ডালিম গাছের বীজ ।স্পষ্ট টের পেলাম , আগামী
দশ বছরের ক্যালেন্ডার ছাপা হয়ে গেল একসঙ্গে ।
২৬) ভালো ভাষা
ওগুলো যে স্বপ্ন ,বুঝে উঠতে লেগেছিল কিছুটা সময় ।
পোষা বেড়ালের ঘাড়ে সিংহের কেশর কীভাবে এলো ,
কীভাবে সে হত্যার প্রয়োজনে সমপরিমাণ ভালোবাসা
সংগ্রহ করেছিল থাবায় ও নখে ,সহজে বুঝিনি ।
ক্রমে ক্রমে ,একে তাকে,জিজ্ঞাসা করে ; জড় ও জীবের মৃদু
সাহায্য পেয়ে বুঝি একদিন ,কেমিস্ট্রির প্রায় সবকথাই
কেমিস্ট্রি বইতে লেখা নেই। উদ্ভিদের মাংসল দেহে আর
মানুষের নিজস্ব ইস্পাত থেকে ক্রমে ক্রমে দেখতে পাই
স্বপ্নের সামগ্রিক দেহ ।
আমার শরীরে জেগে ওঠে দীপার স্তনের স্পর্শ । তবু
আমার তৃষ্ণার আঠা জমে জমে পাথরের রূপ নিয়ে
চিত হয়ে পড়ে থাকে তার দুই নিস্পৃহ চোখের চাতালে ।
লোকে একে স্বপ্ন বলে ।দেখে , সেই স্বপ্ন কীভাবে খেজুর
গাছের শিউলি হয় ।আমি ভাবি - এই হয়তো কবিতার ভ্রম ।
২৭) দেখা
কাঁচা মাটি দিয়ে গড়েছিল কুমোর। বুকের নরমকে মেখেছিল
যত্ন দিয়ে । সেখানে মিশিয়েছিল রাত্রের ঘুম ,স্বপ্ন সমপরিমাণে ।
কুমোরের হাতে গড়া মেয়ে চোখ মেলেছিল ।ঠোঁট নড়েছিল ।
সময়ে সে পেয়েছিল ঋতু ।
সেই মেয়ে একদিন পথে যেতে যেতে দেখে একটি পাথর
এক অহংকারী যুবকের মতো অর্জন করেছে দৃঢ়তা।পেশি আছে ,
অস্থি আছে । সর্বোপরি ভালোবাসা আছে বলে তার প্রেমে
আকাশের বিস্তার বাড়ে ।মাটির মেয়েটি তার প্রেমে পড়ে।
এরপর কলেজ-জীবন।জীবন এখানে এসে দেখতে শেখে ।
জীবনের চোখ থাকে যত জোড়া ,সক্রিয় হয়ে ওঠে ক্রমে ক্রমে ।
চোখে গান আসে ।গান জানে অশ্রুর অনুবাদরীতি।
কুমোরের মেয়ে আর পাথুরে যুবক মিলে পথ তৈরি হয় ।
সেই পথ ধীরে ধীরে সংখ্যায় বাড়ে,অভিমুখ বাড়ে , আর
পথের পথিক, জনে জনে, দূরত্বকে মেনে নেয় শিল্পের কারণে ।
২৮) উল্লম্ফন
ইস্কুল-জীবন ক্রমে শেষ হয়ে এলো ।নিজের দুচোখে
এইবার বুঝে নিতে হবে পৃথিবীটা ঠিক কত বড় ।দেখা চাই
পাথরে কোথায় আছে প্রাণ ।গান আছে ঘাসের শরীরে
সুর ,তাল ,লয় মেনে কীভাবে ।গোপনে প্রকাশ্য হয় ক্রমে
সজীব শরীরে ভাস্কর্য কীভাবে ,দেখা চাই ।
বড় একটা জলাশয় পার হতে হবে এইবার ।লাফ দিয়ে
পার হওয়া যায়,কেউ কেউ পার হয় জলে নেমে, সাঁতার দিয়েও,
ডুব সাঁতারের কলা কেউ কেউ অর্জন করে।দুএকজন তো
উপর নিচ একাকার করে ,গায়ে মেখে নেয় পাঁক , সশব্দ
সাইরেন শুনতে না পেয়ে কেউ কেউ পেটপুরে খেয়ে নেয়
অনুচিত-জল । যুগে যুগে এইখানে তলিয়েও গেছে নাকি
জীবনের আরম্ভ অনেক ।
রাস্তাটি কত বড় ,জানা নেই ।তবু নামতেই হবে এইবার ।
২৯) বয়ঃসন্ধি
কিছুদিন ধরেই চেনা জলকে আর চিনতে পারছে না ছেলেটি ।
হওয়ার শব্দ যেন আর আগের মতো নেই। মাটিতে কান
পাতলে একটা নতুন শব্দ-সংকেত পাচ্ছে ,যার অর্থ সে
জানে না । এমনকি আয়নাও আর আগের মতো সহজ সরল নেই।
নিজের ভেতর থেকে বার হয়ে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে নিজেকে ।
ফিসফাস শব্দটি চতুর্দিকের মানুষগুলোর উপর আধিপত্য বাড়াতে
থাকল। গোপন শব্দটি ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে ।আলো,যে
আলো ,সেও যেন কুয়াশার সঙ্গে ,অস্পষ্টতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে ।
কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না ঠিকঠাক।আবরণগুলো দিনরাত্রি যেন
কীসের ইশারা করছে ,ওরা যেন বলছে...। বুক ঢিপঢিপ করে তার ।
চুকিত্কিত , লুকোচুরির মেয়েগুলো আর তাকে দলে নিলে না ।
এসব নাকি মেয়েদের খেলা।ছেলেদের খেলা খুঁজতে হবে এখন ।
খুঁজতে খুঁজতে সবুজ মাঠের আলপথ ধরে পৌঁছে গেল ভিন্নগ্রহে ।
৩০) ইন্দ্রজাল
সে চলে গিয়েছে অনেক আগে ।সে যে কে ,জানত না
ছেলেটি।লেখকও জানে না।পাঠকেরও তাই জানার উপায়
নেই । ছায়াটি কেবল এখনও রয়ে গেছে ।ছেলেটির সঙ্গে
সে ছায়ার ভাব ,গন্ধ ,বাক্য বিনিময় চলছে হাওয়া ও
আলোর পৌরহিত্যে ।
রাস্তার সঙ্গে বিভিন্নরকম বয়সের কথাবার্তা হয় ।প্রত্যেক
বয়সেরই একটা নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে - সূর্য তাকে
যথাযথ পাত্তা দেয় না ।পক্ষপাতিত্বের দোষে ছোটো বড়
সব গাছ । এবং একই গাছের সব পাতা সমান রেজাল্ট করতে
পারে না কিছুতেই।
ভূতের গল্প ,পরীর গান ,ডিটেক্টিভের ম্যাজিক যখন সেই
সেই বয়সের ছেলেদের অমনোযোগী করে তোলে , কে যেন
তাকে অর্থহীনতার অর্থ খুঁজতে বলে । বুঝত কি ছেলেটি
সেসব অযৌক্তিক প্ররোচনা ?
৩১) আবিষ্কার
দুটো সাপ গল্পগাছা করছিল আমবাগানে ,একান্ত নিভৃতে ।
এখন আমের সময় নয়, আম-লোকও বড় একটা আসে না সেদিকে ।
অসংখ্য গাছের তলা দিয়ে অনেক রাস্তা এদিকে , ওদিকে ,সেদিকে ।
যেন পথিককে বিভ্রান্ত করাই তার উদ্দেশ্য ।যারা পৌঁছাবার আগে
ঠিকানা নির্দিষ্ট করে নেয় ,তাদেরই ঠকায়। আবার অবাক হয়ে
দেখে সেই ভুল ,বেভুল লোকেরাই নতুন রাস্তার জন্ম দেয় ।
বড় রাস্তার গোমর সহ্য হয়নি ছেলেটার।ঢুকে পড়েছিল আমবাগানে।
শঙ্খলাগা সাপেদের দেখেছিল খুব কাছ থেকে। তার ভেতরেও
একটা সাপ যেন ,কুণ্ডলী ছেড়ে ,সোজা হচ্ছিল। ছোবল মারছিল
মনের দেওয়ালে ,আর কিছু ছবি সক্রিয় হচ্ছিল শূন্য ক্যানভাসে ।
আয় ,আয় ,আয় ।গাছেরা ডাকে পরস্পরকে।মানুষের নাম দেওয়া
ইতরপ্রাণীরা ডাকে পরস্পরকে । জড়, অজড় ডাকে পরস্পরকে ।
তারও ভেতর থেকে সেই ডাক উঠে আসছে।শরীরের প্রতিটি অঙ্গ
প্রতিটি কোষ ডাকছে - আয় ,আয় ,আয়।কাকে ডাকছে ? জানে না ।
৩২) বড় হওয়া
আখ-মাড়াই হচ্ছিল আখশালে।মেশিনে পিষে বার হচ্ছিল
আখের রস ।পাশেই দুটো বড় উনুন।লোহার কড়াইয়ে
সেই রস ফুটিয়ে গুড় তৈরি হচ্ছে ।ছেলেপুলেরা গিয়ে দাঁড়ালে
খালিহাতে ফেরায় না তাদের শালের মালিক।একগাছা করে
আখ প্রত্যেককেই দেয় ।
ছেলেটিও সেদিন গিয়েছিল ।এক-গ্লাস টাটকা রস দিয়েছিল তাকে ।
চোঁ চোঁ । তারপর বড় একগাছা আখ আরও ।সেটা নিয়ে
মাঠের মাঝ বরাবর হাঁটতে থাকে সে।এক জায়গায় বিরাট
লম্বা একটা খাল ।কচুরিপানায় ঢাকা । দেখা যায় না আকাশ ।
খালের দুধারে সাদা বকের দল বসে আছে অসীম ধৈর্য নিয়ে ।
চাষিরা একদিন এই খালের জলে তাদের পাটগাছ পচতে দিয়েছিল ।
খালের জলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কীভাবে পাটগাছ থেকে পাট
আর কাঠি আলাদা করছিল লোকগুলো , দেখেছিল সে ।
সাদা বকগুলো সেদিনও ছিল ।একটু দূরে দূরে ।সূর্যের
রূপোলী আলো আর একটা পচা গন্ধ মিশেছিল পাটের গায়ে ।
মাঠ বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বড় হয়ে যাচ্ছিল ছেলেটা ।
৩৩) গ্রাহক হওয়া
একদিন সজনেগাছে মৌমাছি দেখেছি ।একদিন
দেখেছি শাল জঙ্গলে।একদিন জলের বুকে পাথর
দেখেছি,পাথরের চোখে একদিন সমুদ্র ।
আমাদের আমগাছের বাগান আছে , বাগানের মধ্যে
অনেক লেবুগাছ।একই গাছে হনুমান এবং প্রজাপতি বসে
সময়ে সময়ে ।তাদের ভালোবাসা রঙ ও নির্যাতন হয়ে
লেগে থাকে সেইসব গাছেদের অযৌন প্রেমে। জীবনকে
বিজ্ঞান বলে মেনে নেওয়ার ক্লাসে যৌনতা ও
যৌন প্রকরণ নিয়ে ভুল ও সঠিক কিছু চর্চা করা হয়।
সদ্য গোঁফ গজানো বন্ধুদের সিগারেট ,গাঁজা ,মদ ও
খুকিদের নিয়ে কিছু ফিসফাস কল্পনার আড্ডাও চলে ।
ডিম কীভাবে কোন গাছে তৈরি হয় জানার জন্য
লাইব্রেরির গ্রাহক হয়েছি ।
৩৪) কল্পনা
ক্লাস নিতে এলেন রাঘববাবু ।বাংলার শিক্ষক ।পড়ান,
পড়তে শেখান ।লেখান ,লিখতে শেখান ।দেখান , দেখতে শেখান।
অনেক কথা বলেন আর বলিয়েও নেন সবাইকে দিয়ে ।
সেদিন লিখতে দিলেন - জীবনের লক্ষ্য ।
স্কুলের পাশেই একটা বড় পুকুর।পৃথিবীতে তিনভাগ জল
আর একভাগ নাকি স্থল।সেই তিনভাগ জলের মধ্যে
তিনভাগ জলই বোধহয় এই পুকুরটিতে থাকে ।জীবনের
লক্ষ্য খুঁজতে গিয়ে তার চোখে পড়ে সেই পুকুরের জল,
জলের রঙ, পদ্মপাতার উপর বসে থাকা কয়েকটা পাখি।
পুব পাড়ে ঝুঁকে আছে বাঁশের ঝাড়।সেখানে নিশ্চয়ই
তাদের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে অনেক মাছ ।মনে মনে আরও কিছু গাছ
তার পাড়ে পাড়ে বসিয়ে নেয় সে । কদম ,বকুল , তাল,পাকুড় ।
জীবনের লক্ষ্য লেখা খাতগুলো জমা পড়ল।ডাক্তার ,
ইঞ্জিনিয়ার,মাস্টার-দিদিমণিতে ভরে উঠল রাঘব বাবুর টেবিল ।
কয়েকজন ক্রিকেটার ,ফুটবলারও ছিল।আর একজন
মাত্র ছিল কবি ।একা ।মুখ নিচু করে ।কাঁচুমাচু ।শাদা ।
৩৫) উদাসীনতার মোহ
একসময় নাকি এখানে একটা নদী ছিল। এখন সে জায়গাটা
নেহাৎই দীন।ফাঁকা ,শুকনো ,বিমর্ষ মনের ছায়া পড়ে আছে
অবাঞ্ছিত প্রার্থনার মতো।কেউ আসে না এখানে।কেউ কখনও
এলেও ,তার সম্পূর্ণটুকু নিয়ে আসে না ।ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে রাখে ।
অথচ এখানে কোনো নীলকুঠি বা গুমঘর ছিল না কখনও ।
ভুল করতে ভালোবাসা ছেলেটি এখানে আসে।একা বসে থাকে ।
শুনেছে ,একা থাকলে লোকে নাকি চিন্তা করে ।কীভাবে চিন্তা
করতে হয় ,জানে না সে ।ক্রমে ক্রমে দূর থেকে কয়েকটা কর্কশ গলার,
পালক ওঠা ,সঙ্গীবিহীন পাখি আসে তার কাছে , চিন্তার জামা গায়ে দিয়ে ।
অনেকটা দূর দিয়ে কারা একটা মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে ।মুখে তাদের
হরিনামের স্লোগান। যার মৃতদেহ,সে হয়তো অদূরে কোথাও
দাঁড়িয়ে আছে বিরক্তি নিয়ে ।এই বিমর্ষ চিৎকার হয়তো তার
পছন্দ নয় ।শালুকের নাম ,বকুলের নাম ,ঘেঁটুর নাম তার পছন্দ ।
৩৬) চিন্তা
আলো এসে পড়েছিল।সে কি আমন্ত্রিত ছিল? ছিল রবাহূত?
নাকি অনিবার্য ?জানে না ।বালকটি সেদিন প্রথম বুঝল
আলো পড়লে ঘরের চেহারা কেমন হয় ।সে নেহাৎ আর
বালক রইল না ।একটু বড় হলো।কৈশোরকে গ্রামে- ঘরে
দেওয়া হয় না নাগরিক সম্মান ।বলা হয় ডেঁপো ছোঁড়া।
আত্মপরিচয়ে আলো বলেনি সে কোথা থেকে এলো।কে
তার জন্মদাতা।কৌলিন্য কতটুকু আছে ।পাঁক আর এঁটেলের
পার্থক্য কিসে ।কিশোর ছেলেটি বুঝল এর নাম আলো ।
পোড়া হাঁড়ির ভুসো আর বাছুরের মাথায় উঁকি মারা শিং-এ
আলো পড়ল সমান কৌতূহলে।আঁচিয়ে নিলো উচ্ছিষ্ট আড়াল ।
ভেতরে ঢুকতে চাইল আলো।ঘাপটি মেরে অন্ধকার ভেতরে,
বসেছিল।আলোকে তার ভয় খুব।কিশোরের হাত ধরে আলো।
আলোর হাত ধরে কিশোর।পরস্পরের মস্তিষ্কে তখন তৈরি হয়
একটা বৈদ্যুতিক যোগাযোগ।জ্বলে ওঠে সেই কিশোর।আর আলো
চতুর্দিক থেকে মুছে দেয় আয়োজিত বার্ধক্য সব।
৩৭) দৈন্য
অনাহারে আছে ওরা প্রায় তিনদিন । সাত ভাই আর
এক বোন চম্পা। আর পুবে,দক্ষিণে,ঈশান,নৈঋতে যাদের
বাড়ি ,একাধিক যাদের সূর্য ,প্রয়োজনের বেশি আলো ,
ফলের ভারে অহংকারী তাদের গাছ । জলের ঐশ্বর্যে
ছাপুছাপু তাদের শালুক-পদ্মের সংসার ।সব অভাব কেবল
আশ্রয় নিয়েছে এদের ঘরে।ঘৃণা,লাঞ্ছনা,অসম্মান থাকে এখানেই ।
সাত ভাইয়ের এক ভাই সেই বালক ।অনাহারের গল্পেও সে
মুখ্য চরিত্র নয়।ভিড়ের মাঝে ঔজ্জ্বল্যহীন সাধারণ। চোখ
আর চোখের উচ্চারণে বিশেষ কোনো রঙ নেই ।উপেক্ষা ও
অপমানে অবশ্যই সমান অংশীদারিত্ব ।কয়েকটি শালিখ
আর তাদের টুকরো টুকরো ছায়া নিয়ে তার শিশুমনের
গল্পগাছা ।কয়েকটা গুবরেপোকা আর কেন্নো।
বড় বড় ছায়া যাওয়া আসা করে দূর দিয়ে ।সূর্য প্রতিফলিত
হয় তাদের দেহ থেকে ।একটা সুগন্ধ ,একটা নেশা আর
একটা ভয় ছড়িয়ে বেড়ায় তারা ।লুকিয়ে থাকে বালক ।
৩৮) শিশুর প্রেম
সেসব দিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে না ।কোনোটা
বোল্ড অক্ষরে ছাপা হয়ে আছে , বিস্মৃতি তাদের কাছে
পর্যুদস্ত ।কোনোটায় সত্যি-মিথ্যে ,সাদা-কালো , তরল-কঠিন
আধাআধি মিশে গেছে ।নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না ।কোনোটা
সম্পূর্ণই বানিয়ে নেওয়া ।ছিল ভবঘুরে ,হয়ে গেছে হিউয়েন সাঙ্।
বড়দিঘির জলে ভাসতে দেখেছিলাম লালুর দিদিকে। এটুকু
প্রকাশ্য ।অপ্রকাশ্য সত্য হলো ,তাকে ডুবে যেতে দেখেও আমি
চিৎকার করিনি।কাউকে ডাকিনি।চুপ করে তাকিয়ে তাকিয়ে
দেখেছিলাম,মানুষের ডুবে যাওয়া কেমন হয়।আমি তো
জানতাম ,ডুবে গেলেও একসময় ভেসে উঠবেই।ডুবে মরা
আমার দাদুকে, তার হাতের লাঠিটাকেও ভাসতে দেখেছিলেম।
ঝাপানের সাপের ফণা ,মিতালির পিঠের বেণী, বীণাপাণির
বিনা পানি হওয়া ,হাল্কা একটা পর্দার আড়ালে আছে এখনও ।
কিন্তু জীবনে কাকে প্রথম নগ্ন দেখেছিলাম,সেটা সম্পূর্ণই সংগৃহীত ।
৩৯) পাপ
উচাটন,উৎকণ্ঠা ,নিদ্রাহীনতা- এসব তখনও তার শব্দকোষে
ঢোকেনি।কেবল অজানা নয়,সম্পূর্ণ অশ্রুত।হয়তো আরও কয়েকবছর
পর,চণ্ডীদাসের সঙ্গে সামান্য আলাপে,পরিচয়ে , উচাটন প্রাসঙ্গিক
হবে।তখন এক শীতের সকাল ,যে সীমারেখার নিচে দারিদ্র শব্দটি
মাথাগুঁজে থাকে ,সেখানেই ছেলেটি ও তাদের পরিবারের
পৌষ মাস যাপন ।
তখন এক শীতের সকাল ,অকথ্য জাড়ের দাপটে ইতর প্রাণীরাও
শীতার্ত ।গোয়াল ঘরে এক কাজের মেয়ের বুকে যাকে সেই ছেলেটি
তখনও বুক বলে চিনতে শেখেনি ,জ্বলন্ত আগুন দেখেছিল ।
উতপ্ত স্পর্শ তাকে বলেছিল সেখানে আগ্নেয়গিরি আছে ।
এক সুন্দর দুর্ঘটনা ঘটেছিল।কীভাবে ম্যাজিক দেখা শিখতে হয়
শিখেছিল দুটো অবাঙ্ বিস্ময় ।একসঙ্গে তারা আবিষ্কার করে
বাগানে জামির গাছ ফলে ভরে গেছে ।জামির নিজের স্বাদে
আউলিয়ে ওঠে
৪০) দুষ্টুমি
কেবল অপরাধ করার ইচ্ছে হতো ।চুরি করে খাওয়া ছিল
এক পবিত্র অপরাধ ।কাউকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া ,স্কুলে
কারো টিফিন চুরি করা ,আড়াল থেকে ঢিল মারা , চুপিচুপি
পিছন থেকে ইজের টেনে নামিয়ে দেওয়া,এসব ছিল খেলা মাত্র।
আরও একটা খেলা ,কোথা থেকে মাথায় এসেছিল কেজানে ,
কেনইবা এসেছিল,যাকে সামনে থেকে দেখার কোনো বাধা নেই
তাকে লুকিয়ে দেখার ইচ্ছে ।
আমি যখন অপরাধ করি ,বাড়ির গাছপালারা ভীষণ
খুশি হতো ।বিশ্বাস করবে না হয়তো ,তোমাদের হরিমঞ্চের
তুলসী ঠাকরুনও।খুশি হতো বাড়ির বেড়াল, কুকুর, গরু ও
তাদের বৎসরাও।খুশিতে হো-হো করে ঝরে পড়তো নলকূপের জল ।
বাড়ির একটা ঘরে সবসময় তালা থাকত।কেন জানি না। সে ঘরে
যে থাকত ,সে আমার ভীষণ প্রিয় ছিল ।আমাকে ভালোবাসতো ।
আমি তাকে কখনও দেখিনি ,সেও আমাকে ।তবু আমি সেই ঘরের
দরজার বাইরে বসে বসে তাকে গান শোনাতাম।আমার গানের
বাণী ও সুর ছিল সততই পরিবর্তনশীল ও কর্পূর জাতীয় ।
৪১) উপলব্ধি
আকাশ জুড়ে বিরাট বড় একটা দুধে-আলতা চাঁদ , আমার
ভাত খাওয়ার স্টিলের থালাটার চেয়েও বড়। তাকে যথেষ্ট
জায়গা দিতে আকাশটা যেন খুব ছোটো হয়ে গেছে। সেই
চাঁদের নিচেই ,যেন তার নিঃশ্বাস গায়ে পড়ছে ,বসে আছে একটা
মেয়ে ।তাকে সোনালী বলা যায় ,রূপালী বলা যায় , বলা যায়
দিপালী ।জ্যোৎস্না মাখা মেয়েটা গল্প করছে চাঁদের সঙ্গে ।
তার ঝাঁকড়া চুলের ঝকমকিতেই নিশ্চয়,ঔজ্জ্বল্য বেড়েছিল চাঁদের ।
তখন আমাদের বাড়িতে কোনো পাঁচিল থাকত না ।দেওয়াল
থাকত না ঘরে ।সমস্ত পাড়াটা হয়ে উঠতো পাল্লা বিহীন ,
ফ্রেম বিহীন ,সীমাহীন অনন্ত।দীপুর দাদার ফুটবল খেলার
মাঠের চেয়েও বড় ।
বড় হওয়ার যে কী আনন্দ ! বড় হওয়ার সময় আরও বেশি
শিশু হয়ে ওঠার আনন্দ ।অনুভব করতে হলে বড় হতে হবে ,
ছোটো হতে হবে সম্পূর্ণ ।
৪২) অংক
অংকের ক্লাসে সব অংক ভুল হলো ।লক্ষের সঙ্গে লক্ষ
যোগ করার পর যোগফল নেমে এলো হাজারে ।পাঁচ থেকে
দুই বাদ দেবার পর হাতে থাকল সাত। হাসাহাসি করল বন্ধুরা ।
ভুলের আয়োজন দেখে অংকের দিদিমণি দিলেন কানমলা ।
শিশুর বিষণ্ণ মনের কথা বুঝল পুব ,দক্ষিণের বাগান ,
ঈশান ,নৈঋতের পুকুর ।তারা তাকে কাছে বসাল, গল্প করল ।
সবুজ ফসলের মাঠে যত হাওয়া ছিল ,মাঠে আলের গর্ত
যত ইঁদুর ছিল , বড় বড় গাছের ডালে হেঁটমুণ্ড বাদুড় ,
তালগাছের মাথায় শকুন আর মাটির রাস্তায় যত দাগ
রেখে যত গরুর গাড়ির চাকা,তারা সবাই ছেলেটিকে রাখত
নজরে নজরে ।
একদিন একদল শালিখ আর চড়ুই পাখির ঝাঁক উড়াউড়ি
করতে করতে তার সব যোগ আর বিয়োগ সঠিক করে দিল ।
সেদিন থেকেই ছেলেটি সব পরীক্ষায় প্রথম হতে শুরু করল ।
কে জানত ,প্রথম হওয়া এত সহজ , ফেল করার চেয়েও !
৪৩) সরলতা
নাককাটা রাজার অবস্থা কল্পনা করে ছেলেমেয়েরা
হেসে কুটিপাটি।গল্পের দিদিমণি শাড়ির আঁচল থেকে একটা
কোণা সরু করে পাকিয়ে কানের ভেতর ঢুকিয়েছেন,
আরামে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে ।রাজার কাটা
নাকের রক্তে দুনিয়া তখন ভাসছে । ছেলেটার হঠাৎ
নিমাই ডাক্তারের কথা মনে হলো।ওকে ডেকে নিয়ে যাওয়া
দরকার সেই রাজার বাড়ি ।কিন্তু সে চেষ্টা যে এখানে
কারো নেই !হতভম্ব ছেলেটা ভাবছে , নাককাটা রাজা
তবে ইস্কুলে আসবে কীকরে !
মাটির দেওয়ালের ক্লাসঘরে কয়েকটা ইঁদুরের গর্ত আছে ।
তার একটা গর্তের মুখে কে যেন মাঝেমাঝে উঁকি মেরে মেরে
দিদিমণির গল্প শুনছিল ।একসময় রাজার চিন্তায় সেও
হয়তো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল ।গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল ।
দিদিমণির সেদিকে চোখ পড়তেই ,আতংকে চিৎকার -সাপ !সাপ !
ইস্কুলের সিদ্ধেশ্বর মালি সেটাকে মেরে ফেললে । বললে -
জাত সাপ দিদিমণি ! মরা সাপের রক্তাক্ত শরীরটা দেখে
রাজার নাকের ব্যথা ভুলে গেল ছেলেটা ।
৪৪) পরিচয়
আমার বয়স তখন পাঁচ ।আম ,জাম ,কাঁঠাল , পেয়ারা
চিনে ফেলেছি । কুল ,তেঁতুল ,আমড়া, ডেলো চিনেছি ।
চিনেছি গাঁদা,টগর ,বকুল,কদম । বাবু বাগদি , মদনা,
গৌতম ,শুকো - এরা বন্ধু । মিলি ,মালা ,নক্কি ও ডাবা -
এরা সব বন্ধুর মতোই ।
আমাদের বাড়ির চারধারে আট-দশখানা রাস্তা ছিল।
প্রতিটি রাস্তাই গিয়ে পৌঁছাত ভূতের গলিতে।লোকে
বলে রাস্তাগুলো নাকি আসত সেখান থেকেই ।তিনটে
বেড়াল : কালো ,লাল-সাদা ও রয়েলবেঙ্গল টাইগারের
ছোটভাই ধুমসো হুলো ; চারটে কুকুর : কানা,লেজ কাটা ,
ল্যাংড়া ও সুন্দরী কমলি, - এরা সাতজন একটা মাত্র
রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করত সারাদিনে । রাতে
এদের চোখ ।
আমার দাদুর দুটো গরু ছিল । নাম , শ্যামলী আর ধবলী ।
আমাকেও ওরা চিনত নাম দিয়ে ।ডাকত, কথা বলত।
লেজের ঝাপটা দিয়ে আদর করত ।
৪৫) হাঁটি-হাঁটি
হামা ও পতন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা।মাটির উপর
ছায়া পড়ছে লম্বা লম্বা। পুঁইমাচার শালিক তাকে ডাকে ।
তালগাছের মাথা থেকে বাবুই । দিনরাত অবিরাম
লোক যাওয়া আসা করে বাড়িতে ।তারা প্রত্যেকেই ওর সঙ্গে
কিছু না কিছু বলে । ছেলেটা কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমা করে
সেসব কথা ।
দুর্গাপুজোর দুর্গা তার বাড়িতে আসত সপরিবারে প্রতিবছর ।
মণ্ডপে এসে প্রথমেই সে ডেকে পাঠাত ছেলেটিকে।আরও
অনেকেরই অবশ্য ডাক পড়ত সেখানে । ছেলেটা খুশি মনে
কার্তিক ,গণেশের সঙ্গে খেলা করত । ওদের দুই বোনকে
দেখত দূর থেকে । ওরা কি গুলিডাণ্ডা, মার্বেল খেলা
জানে ? ভাবত ।
নিজের পায়ে দৌড়াতে শেখা ছেলেটা কী ভাবত ?ভাবনা
কি ওকে গ্রাহ্য করত , তাচ্ছিল্য করত বাচ্ছা বলে ?
৪৬) হামা
তখন চিত হয়েই শুয়ে থাকতাম।তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম
ঘরের ছাদ,যেটাকে অনেকদূর মনে হতো ,নাগালের বাইরে ।
আড়চোখে ডানদিক,বামদিকও দেখতে পেতাম কিছুটা কিছুটা ,
তিরিশ ডিগ্রি বা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে। আমার মা অথবা
বাড়ির অন্যান্য বড়রা ,কেউ কেউ কখনো কখনো, ডানপাশে
কিংবা বামপাশেও শুইয়ে দিতেন।তখন কেবলমাত্র একটা
দিকই দেখতে পেতাম আমি।অন্য সবই থাকত দৃষ্টির আড়ালে ।
প্রথম যেদিন আমি নিজেনিজেই উপুড় হতে শিখলাম,
পিঠের নিচটাকেও দেখার সুযোগ পেলাম ।সারা বাড়িময়
রটে গেল আমার বড় হওয়ার খবর ।
কয়েকদিনের মধ্যেই আমি চার হাত-পা ব্যবহার করে
স্থান পরিবর্তন আয়ত্ব করলাম।জায়গা পরিবর্তনের এই ক্ষমতাকে
বাড়ির লোক ভয় পেতে লাগলো ।কখন কোথায় চলে যাই ,
কখন কিসে হাত বাড়াই ! বেঁধে রাখার জন্য দড়ির আবিষ্কার হলো
তখনই ।দামাল ছেলে বলে কথা !
৪৭) স্তনপান
শিশুটি মায়ের কোলে। মা তাকে খুলে দিয়েছে অফুরন্ত
আহার্য ভাণ্ডার। পানরত শিশুটি দুহাতে ধরে আছে ননির হাঁড়ি।
চোখের দৃশ ধাতুটিও কাজ করছে । দেবার সুখে পরিতৃপ্ত মা
তার গায়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে ,চুম্বন করছে।অনতিদূর থেকে
এক যুবক এসব দেখছে।যুবতীর অনাবৃত স্তন থেকে
দুরকমের রস, ধারা পাচ্ছে । অন্য ধারাটিতে পুষ্ট হচ্ছে
সেই যুবক । শিশুটি সে যুবককে চেনে না ।
একমাত্র আলো এই সত্য জানে ।অন্ধকার যে আলোকে
আড়াল করতে পারে না।দুরকমের তড়িৎ আধানের মাঝ থেকে
দূরত্বের সরলরেখা মুছে গেলে ,সৃষ্টি হয় সেই আলো।
দুদিকে দুটো বড় বড় পাইনগাছ বেড়ে উঠছে।মাঝে একটি
আগামীদিনের নকশা ।আর কিছু আবহ সঙ্গীত।সৃষ্টির সেই
শূন্য-যুগ থেকে, যে নীরবে এবং বিমূর্তভাবে বাদনরত। সেই
সঙ্গীত থেকেই সৃষ্টি হয় মায়ের বুকের দুধ ।
৪৮) ভূমিষ্ঠ
অবধারিতভাবে গোয়ালঘর বা ঢেঁকিচালা নয় , পৃথিবী
আমার প্রথম পদচুম্বন পেল এক হাসপাতালে। অদূরে গঙ্গা ,
যে প্রতিদিনই জন্ম-মৃদঙ্গের লহরী শোনে সেই হাসপাতাল থেকে,
সেদিনও শুনল,খুবই নির্বিকারভাবে।দক্ষ নার্সদিদির দুহাতের
তালুর উপরে, আমি তখন প্রতিবাদের শব্দ তৈরি করছি,
যেমন করে আর পাঁচজন ।কোথাও কিছু নতুন নেই। একজন
ডাক্তারবাবু আমার মাকে পরীক্ষা করলেন।বললেন - সম্পূর্ণ ওকে ।
অথচ আমার কোথাও কিছুটি ওকে মনে হচ্ছিল না। মায়ের
গর্ভের কাঁথা-ক্ম্বলের ওম থেকে এ কোথায় এসে পড়লাম !
৪৯) মায়ের আটমাস
আমি তখন আর শুধুমাত্র জাইগোট নেই।অনেকটাই
'আমি-আমি' হয়ে উঠেছি । ভাবী-আমিকে নিয়ে অনেক
কল্পনার আল্পনার জল্পনা চলছে ।পৃথিবীর কথাবার্তা ,
পৃথিবীর নানান ছবি ,যার কিছুটা রিয়েলিস্টিক , কিছুটা
অ্যাবস্ট্রাক্ট, - অসম্পূর্ণ কানে শ্রুত হচ্ছে ,অস্ফুট চোখে
দৃষ্ট হচ্ছে ।এক অদৃশ্য কুমোরের হাতে পুতুল গড়ার কাজ চলছে ।
পুতুল তখনও জানে না তার আকার কেমন হবে , কলসির মতো না কলের মতো ।
পৃথিবীতে প্রত্যেকটি জিনিষেরই একটা করে নাম থাকে,
জড় হোক বা জীব ।কিন্তু প্রয়োজনে একাধিক নাম, বিশেষ নাম ,
জাত ,কুল ,শীলের নামও থাকে ।থাকে নির্দিষ্ট সংখ্যার নাম ।
বাবা মায়ের মধ্যে সেসব নাম নির্ধারণ করার কাজ চলছে ।
অভিমন্যুর মতো আমি তার কিছু কিছু জেনে বুঝে নিচ্ছি নীরবে ।
এইসব জাগতিক ও কাল্পনিক ,গাণিতিক ও গণিত ছাড়া ঘটনার
মধ্য দিয়ে নিজের হাত পা পেয়ে যাচ্ছি ,নাক চোখ টের পাচ্ছি ।
ভূমিষ্ঠ হতে তখনও দুএক মাস বাকি ।
৫০) জন্ম
একজন যুবতী ছিলেন পৃথিবীতে ।যেমন আরও কোটি কোটি
যুবতী থাকেন ।একজন যুবকও ছিলেন ওইরকমই।এই যুবক
আর ওই যুবতীর মাঝে একটা দীর্ঘ রেখা ছিল ।সে রেখা
কখনো সরল ,কখনো জটিল ।সে রাস্তার মাঝে অনেক মোড় ছিল ।
কর্ণওয়ালিশ মোড়,লালকেল্লা মোড় বা ফুলঝোড় নামের
কোনো গ্রামের মোড় ।এইসব মোড়ে মোড়ে ওদের জন্য
ছিল অনেক আমন্ত্রণ ,নিমন্ত্রণ।
প্রেম নামক একটি রাসায়নিক ঘটনা ক্রমে ক্রমে সেই দীর্ঘ রাস্তাটিকে
কাঠি-লজেন্সের মতো ,ঝুড়ি-ভাজার মতো খেয়ে নিল। একদিন
মেয়েটি ছেলেটিকে অভয় দিল পৃথিবী আবিষ্কারের জন্য ।ছেলেটি
ওর ভেতরের প্রতিটি পৃষ্ঠা ,লাইন ,অক্ষর পড়ে ফেলল।এরকম
আবিষ্কারক কাজের সময় একটা উষ্ণতার সৃষ্টি হয়।তখন
সেই সৃষ্টি উষ্ণতার কাছে সৃষ্টিকর্মের ট্রেনিং নেয় সরাসরি ।
লোকে এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বলে ভালোবাসা ।
সেইরকমই একটি ভালোবাসার জন্য যে ভ্রূণটির জন্ম হয়েছিল
তার জন্মদিন নির্ণয় করেছিলেন একজন গাইনোকোলজিস্ট।
- Get link
- X
- Other Apps